Child Marriage : বিয়ে ভেঙে, বাড়ি ছেড়ে স্বপ্নের পথে
এই সময় | ১৬ এপ্রিল ২০২৪
অন্বেষা বন্দ্যোপাধ্যায়
রেজ়াল্ট হাতে নিয়ে বিশ্বাস করতে পারছিল না জি নির্মলা। চোখ কচলে বার বার দেখছিল ওটা ওরই নম্বর কি না — ৪৫০-এ ৪২১! তার পর নিজের গায়ে চিমটি কেটে যখন নিশ্চিত হলো, তখন আর চোখের জল বাঁধ মানেনি। সারা রাজ্যে অন্ধ্রপ্রদেশ বোর্ডের ক্লাস ১১-এর পরীক্ষায় সে প্রথম হয়েছে! সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুকে জড়িয়ে ধরেছিল, তার পরে শিক্ষিকার আশীর্বাদ নিয়ে কান্নাভেজা চোখে বলেছিল, ‘আমি পেরেছি।’কুরনুলের কস্তুরবা গান্ধী বালিকা বিদ্যালয়ে (KGVB) সে দিন উৎসব। না, নির্মলার প্রথম হওয়ার জন্য শুধু নয় বরং তার জেদের কাছে হেরে গেছে সব প্রতিবন্ধকতা, সে ছুটছে নিজের স্বপ্ন সফল করতে, তাই। কে এই সপ্তদশী, কেন বা তাকে নিয়ে এমন উচ্ছ্বাস? সে নিজের বিয়ে রুখে পড়াশোনার জন্য বাড়ি ছেড়েছিল গত বছর। দেশে যে লক্ষ লক্ষ বালিকার বিয়ে হয়ে গিয়ে স্বপ্ন গুমড়ে মরে প্রতি নিয়ত, সেখানে নির্মলা যেন সত্যিই এক ঝলক টাটকা বাতাস, যে শুধু নিজের বিয়ে আটকে থেমে যায়নি, প্রমাণ করে দিয়েছে — সুযোগ পেলে সবাই পারবে।
খুব টানাটানির সংসার নির্মলাদের। তার চার দিদির আগেই বিয়ে হয়ে গেছে, সকলেরই ১৮ পেরনোর আগে। তাই গত বছর যখন ক্লাস টেনের বোর্ডের রেজ়াল্ট বেরলো, মা-বাবা জানিয়ে দেন যে তার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন তাঁরা। আর পড়াশোনা করানোর মতো সাধ্য নেই। মানতে পারেনি নির্মলা। সে যে আরও পড়তে চায়। হতে চায় আইপিএস অফিসার। সুযোগ খুঁজতে থাকে কী ভাবে এই বিয়ে ভাঙা যায়। সুযোগ আসে হঠাৎই। গরিবদের জন্য সরকারি প্রকল্প যা যা রয়েছে, সেখানকার স্থানীয় এমএলএ ওয়াই সাইপ্রসাদ রেড্ডি তা নিয়ে প্রচার করতে আসেন।
ষোড়শী দৌড়ে গিয়ে তাঁর কাছে বলেন, ‘আমি বিয়ে করব না। পড়াশোনা করতে চাই...।’ প্রচার থামিয়ে তিনি পুরোটা শোনেন নির্মলার কাছে। মুগ্ধ হয়ে যান ষোড়শীর ডেডিকেশনে। সঙ্গে সঙ্গে জেলাশাসককে পুরোটা জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন এমএলএ। দিন কয়েকের মধ্যেই জেলা প্রশাসন উদ্যোগ নিয়ে আন্ডার প্রিভিলেজড মেয়েদের জন্য আবাসিক স্কুল KGVB-তে ভর্তি করে দেয়। ভেঙে দেওয়া হয় ‘স্থির হয়ে থাকা’ বিয়েও। যে স্বপ্ন মরে যেতে পারত, নির্মলার অসীম সাহসের জেরে তা ধীরে ধীরে ডানা মেলছে।
অন্ধ্রের এই কন্যা অবশ্য শুধু নিজের কথা ভাবে না। সে বলছে, ‘আমি জানি বাল্য বিবাহ আমাদের দেশে বন্ধ হওয়া খুব কঠিন। তাই আমি আইপিএস অফিসার হতে চাই। পুলিশ হয়ে এই সামাজিক অপরাধকে নির্মূল করতে চাই।’ সে হয়তো তামিলনাড়ুর এন অম্বিকার নাম এখনও জানে না। কিন্তু তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন, স্বপ্ন দেখতে পারলে আর নিজের উপর বিশ্বাস থাকলে আসলে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়।
মহারাষ্ট্র ক্যাডারের আইপিএস অফিসার অম্বিকার বিয়ে হয়েছিল মাত্র ১৪ বছর বয়সে! স্বামী ছিলেন পুলিশ কনস্টেবল। অম্বিকার ১৮ বছরের আগেই তাঁদের দুই সন্তানের জন্ম। না, তিনি মেনে নিতে পারেননি এই জীবন। স্বামীকে জানান মনের কথা। তিনি বাধা দেননি। সংসার ও বাচ্চাদের সামলে ক্লাস ১০ থেকে শুরু করে গ্র্যাজুয়েশন — সবই প্রাইভেটে পাশ করেন অম্বিকা। তার পরে চতুর্থ বারের চেষ্টায় ২০০৮-এ UPSC CSE পাশ করে নিজের লক্ষ্যভেদ করেন। বর্তমানে তিনি মু্ম্বই পুলিশের ডেপুটি কমিশনার। বললেন, ‘বাল্য বিবাহ নির্মূল করতেই হবে। তবে একান্তই না করা গেলে বিয়ের পরেও নিজের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রেখে নির্দিষ্ট পথে চলতে হবে। সেটা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়।’
মাসুদা, রিয়া, রুমি, শাবানাদের (সকলের নাম পরিবর্তিত) কাছে তাই নির্মলা এখন রোল মডেল। কারা এই মেয়েরা? ওদের প্রত্যেকের মধ্যেই আসলে একেক জন নির্মলা লুকিয়ে আছে। মুর্শিদাবাদের মাসুদাকে ১৪ বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে দিতে চেয়েছিল বাড়ির সকালে। মূল কারণ দারিদ্র্য। মা-বাবাকে বোধাতে না পেরে মরিয়া হয়ে ফোন করে বসে হবু বরের বাড়িতে। সাফ বলে, ‘আমি পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াব। এই বিয়ে হবে না।’
নিজের জেদে অনড় থেকে মাসুদা এই বছর উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছে। প্রথম শ্রেণিতে পাশ করে এখন বিএ ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছেন। পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের রুমি আবার বিয়ের দিন সকাল বেলা পালিয়ে স্কুলের এক টিচারের বাড়িতে চলে যায়। তাঁকে বলে যে তার জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেই শিক্ষিকা জেলা প্রশাসনকে জানিয়ে মেয়েটির জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। মা-বাবাকে বোঝানো হয়। সে সামনের বার মাধ্যমিক দেবে।
নির্মলার কথা বলতে পূর্ব মেদিনীপুরের ক্লাস ইলেভেনের ছাত্রী রিয়া বলল, ‘সত্যি! আমারও তো তিন দিদির বিয়ের পরে আমি বিয়ে ঠিক হচ্ছে শুনে আমাদের গ্রামের কন্যাশ্রী ক্লাবকে জানিয়েছিলাম। ওরা বিয়েটা হতে দেয়নি। আমি এখন পড়ছি স্কুলের হস্টেলে থেকে। আমার স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখার খোরাক জোগাল নির্মলা।’ মাসুদা আর রুমি বলল, ‘আমরা সব সময়েই ভেবেছি পুলিশ বা আইনজীবী হব, কারণ তাতে আমরা পাওয়ারফুল হতে পারব। বাল্যবিবাহ বন্ধ করা না গেলে তো খুব বিপদ। নির্মলা আমাদের রোল মডেল আজ থেকে।’ শাবানা আর একটু এগিয়ে বলল, ‘নির্মলা আমাদের কাছে শক্তির আর এক নাম। যে মেয়েরা আত্মবিশ্বাস হারাবে, তাকে আমরা নির্মলার গল্প বলব। যেন রূপকথা।’
বহু বছর ধরে বাল্য বিবাহ নিয়ে কাজ করা সমাজকর্মী ও আইনজীবী ভুবন ঋভু বললেন, ‘আসলে বাল্য বিবাহ তো কালচার অফ রেপ। সেটা দেশজুড়েই আছে। তাই এই অপরাধ বন্ধ করতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ।’ এই প্রতিধ্বনি শোনা গেল অন্যত্রও। উজ্জীবিত হলো বাংলার বহু জেলার কন্যাশ্রী ক্লাব ও স্বয়ংসিদ্ধা দলের যোদ্ধারা — যাদের লক্ষ্যই এখানে বাল্যবিবাহ রুখে দিয়ে প্রত্যেককে স্কুলে ফেরানো। কে বলতে পারে নির্মলার ‘রূপকথা’ হয়তো বা পক্ষীরাজে রাজকুমারকে বাদ দিয়েই আরও অনেকের বাস্তবের ‘রূপকথা’ তৈরি করে দেবে!