• Election: ‌‌ভোট দিতে পারলে বুঝি, বেঁচে আছি
    আজকাল | ১৬ এপ্রিল ২০২৪
  • যামিনী মণ্ডল:‌ সেই কবে থেকে ভোট দিচ্ছি। আমি তো পড়তে শিখিনি। তাই চিহ্ন দেখে ভোট দিই। গতবারও হুইলচেয়ারে গিয়ে ভোট দিয়ে এসেছি। এবার বোধহয় আর পারব না। ওঁরা যদি আমার বাড়িতে এসে আমার ভোটটা নিয়ে যায়!‌ আসলে ভোটটা দিতে পারলে মনে হয় বেঁচে আছি। বেশ ভাল লাগে। কতদিনের অভ্যেস।সেকালে অবশ্য ভোটের চেহারা এমন ছিল না। ভোটের দিনটা আমাদের কাছে ছিল দুর্গাপুজোর মতো। নতুন শাড়ি পরে সেজেগুজে ভোট দিতে যেতাম। ভেতরে ভেতরে একটা উত্তেজনা আর ভাললাগা কাজ করত। ভোটের দিনটাকে মনে হত বিশেষ একটা দিন। সারাবছর বাড়িতে স্বামী, ছেলেমেয়ে, সংসারের পিছনেই সময় কেটে যেত। গ্রামের পুজো দেখতে দুর্গাপুজোর সময় ছাড়া তেমন একটা বাইরে বেরোনো হত না। তাই ভোটের দিন সকালে উঠেই স্নান সেরে নিতাম। বাড়িতে রান্নার ঝঞ্ঝাট রাখতাম না। আমাদের তখন বেশ অভাবের সংসার। তবু বাক্সে দু–একটা যে শাড়ি আছে তা থেকেও বাছাই করে রাখতাম। সেটি পরে যেতাম ভোট দিতে। লাইনে অনেকক্ষণ দাঁড়াতে হত। কিন্তু তাতে কোনও কষ্ট হত না বরং বেশ মজা হত। কারণ গ্রামের অনেক মহিলা, দূরের আত্মীয়, অনেক দূরের পরিচিতরা ভোট দিতে এসেছেন। তাঁদের সঙ্গে দেখা হত যে!‌ লাইনে দাঁড়িয়েই চলত হাসি, ঠাট্টা, মজা, এ–বাড়ি ও–বাড়ির চর্চা। আমার চার ছেলে। এক ছেলে চাকরি করে দূরে। ভোট এলেই চলে আসত। শুধু ও নয়, যারাই একটু দূরে থাকত ভোটের সময় ঠিক চলে আসত সবাই। ভোটের লাইনে পাড়া প্রতিবেশীদের সঙ্গে ওদেরও দেখা হত, কথা হত। এখন আমার বয়স ৯১ বছর। বাড়ি আমার পূর্ব মেদিনীপুরের ময়না থানার অন্তর্গত আড়ংকিয়ারানা গ্রামে। তমলুক শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে। লোকসভা কেন্দ্র তমলুক এবং বিধানসভা কেন্দ্র ময়না। এই পূর্ব মেদিনীপুরেই সাতপুরুষ ধরে আমাদের বাস। আমার স্বামী, শ্বশুর, দাদু, দাদুর দাদু, তাঁর দাদু— সবাই এই ময়নারই বাসিন্দা। গাঁয়ে–গঞ্জে কিন্তু আমরা মহিলারা দল বেঁধে ভোট দিতে যেতাম। আবার হই হই করতে করতে একসঙ্গে ফিরতাম। তেমন কোনও ঝুটঝামেলার কথা মনে পড়ে না। ভোট হত অনেক রাত অবধি। আমরা মেয়েরা ভোট দিয়ে বাড়ি ফিরে সন্ধেবেলায় সবাই বাড়ির উঠোনে। গোল হয়ে বসে মুড়ি খেতাম আর ভোটের গল্পেই মশগুল থাকতাম। চড়ুইভাতির মতো ছিল। তখন তো টিভি ছিল না, বিদ্যুৎও ছিল না। বাড়িতে অন্যদিনের তুলনায় একটু বাড়তি ভূরিভোজের আয়োজন থাকত। বুথের বাইরে রাস্তাঘাটেও বিভিন্ন দল একটু আধটু জল, চা, খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করত। সবার বাড়িতে তো রেডিও ছিল না। তাই ফল ঘোষণার দিন পাড়ার সবাই মিলে কারও একটা বাড়িতে জমায়েত হত। রেডিওতে আমার স্বামী, ছেলেরা শুনত ভোটের খবরাখবর। আমরা মেয়েরা থাকতাম একজোট হয়ে।প্রথাগত পড়াশোনা হয়নি। রাজনীতির ‘‌র’ বুঝি না। ছেলেদের কাছ থেকে শুনে শুনে সাময়িক খবরাখবর জানার চেষ্টা করি। ইদানীং ভোট নিয়ে বেশ ঝুটঝামেলার কথা কানে আসে। সে সময় এমনটা ছিল না। থাকলেও এত কম যে সবার কানেই আসত না।আর একটা কথা। ওই সময় কেন্দ্রীয় বাহিনী বলে কোনও শব্দও শুনিনি। তা খায় না মাথায় দেয় জানতাম না। এখন তো কথায় কথায় এই নামটা শুনি। আমি অবিভক্ত বাংলা দেখেছি। অনেক লড়াই দেখেছি। তখন আলাদা আলাদা এত দল ছিল না। আমার চার ছেলেই সরকারি চাকরি করে। আমরা কৃষক পরিবার। চাষবাস করেই ছেলেদের মানুষ করেছি। আমাদের পরিবারের কেউ কখনও রাজনীতির সঙ্গে কোনওদিন যুক্ত ছিল না, এখনও নেই। বাগচা গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে আড়ংকিয়ারানা কালীতলা প্রাথমিক বিদ্যালয় হল আমাদের বুথ। গেল বারেও সেখানেই আমি ভোট দিয়েছি। হুইলচেয়ারে বসে ভোট দিয়েছি। তবে এ বছর শরীরটা খুবই খারাপ। তাই কতটা পারব, চিন্তায় আছি। আমার ভোটটা যদি বাড়ি এসে নিয়ে যেত!‌ আসলে ভোটের অধিকারটা পেলে ভাল লাগবে। আমি যে বেঁচে আছি সেই অনুভূতিটা পাব।‌‌
  • Link to this news (আজকাল)