এই সময়: বিজেপি হোক বা তৃণমূল, ভোটের মুখে সবাই হাজির রামচন্দ্রের দরবারে। সবারই লক্ষ্য নিজেকে ‘আসল রামভক্ত’ হিসেবে প্রজেক্ট করা। বুধবার, রামনবমীর দিন ঘাটালের তৃণমূল প্রার্থী দেবের মুখে শোনা গেল ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান! যা শুনে বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর কটাক্ষ, ‘ভক্তিতে নয়, ভয়ে জয় শ্রীরাম বলছেন দেব।’কেন ভয়? শুভেন্দুর ব্যাখ্যা, ‘মোদী সরকার ফের ক্ষমতায় এলে দুর্নীতিবাজদের যে ছাড়া হবে না, সেটা অনেকেই বুঝতে পেরেছেন। তাই আগে থেকেই রামকে ডাকছেন।’ তবে বিজেপি যে কাউকে ভয় পায় না, সে বার্তা বুধবার রাজ্যজুড়ে দিয়েছে গেরুয়া শিবির। প্রশাসনের যাবতীয় নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বহু জায়গায় রামনবমীর শোভাযাত্রায় অস্ত্র হাতে হাঁটতে দেখা গিয়েছে বিজেপি নেতা-কর্মীদের। যা নিয়ে ফের সমালোচনার মুখে গেরুয়া নেতৃত্ব।
ক’বছর ধরেই রামনবমী উদ্যাপন করতে দেখা যাচ্ছে তৃণমূল নেতানেত্রীদের। তবে এ বার লোকসভা ভোটের আবহে রামনবমী পালনে তাঁদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। দেব, রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবাংশু ভট্টাচার্যের মতো তৃণমূল প্রার্থীরা এ দিন একসুরে বলেন, ‘রাম কারও একার নাকি! রাম তো সবার। ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।’ বেশিরভাগ তৃণমূল প্রার্থীই এ দিন নিজেদের মতো করে রামনবমী পালন করেছেন।
জেলাস্তরের নেতারাও সামিল হন শোভাযাত্রায়। পাল্টা বিজেপির তরফে উড়ে আসে খোঁচা ও কটাক্ষ। রাজ্য বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের খোঁচা, ‘সীতাহরণের সময়ে রাবণকেও একবার গেরুয়া পোশাক পরতে হয়েছিল। তৃণমূলের এখন তেমন দশা।’ বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ শমীক ভট্টাচার্যের ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য, ‘সমাজকে রামময় করে তোলাই আমাদের লক্ষ্য। যা কিছু হচ্ছে, আমাদের অ্যাজেন্ডা মতোই হচ্ছে।’
যুযুধান দুই শিবিরের দড়ি টানাটানির আবহে অবশ্য ধরা পড়েছে অন্য চিত্রও। বুধবার শিলিগুড়িতে শোভাযাত্রায় পাশাপাশি হাঁটেন দার্জিলিংয়ের বিজেপি প্রার্থী রাজু বিস্তা আর তৃণমূল কংগ্রেসের শিলিগুড়ির জেলা সভানেত্রী পাপিয়া ঘোষ! শিলিগুড়ির বিজেপি বিধায়ক শঙ্কর ঘোষও ছিলেন সেই ভিড়ে। পাপিয়া জলের বোতল বিলি করেন রামভক্তদের। দেদার সেলফিও তোলেন গেরুয়া ঝান্ডাধারীদের সঙ্গে। মিছিল দেখে তখন বোঝা দায়, কে তৃণমূল আর কে-ই বা বিজেপি!
তবে এক মিছিলে হাঁটলেও রাজনৈতিক আকচা-আকচি যে চলবেই, সেটা অবশ্য শোভাযাত্রা শেষে স্পষ্ট করে দিয়েছেন দু’জনেই। পাপিয়ার সাফ কথা, ‘রাম আমাদের সবার আরাধ্য দেবতা।’ তাঁকে রামনবমীর মিছিলে হাঁটতে দেখে অবশ্য কটাক্ষের সুযোগ ছাড়েননি রাজু। তিনি বলেন, ‘দেরিতে হলেও কেউ যদি উপলব্ধি করেন যে রাম ছাড়া আমরা অসম্পূর্ণ, তা হলে সেটা অবশ্যই ভালো ব্যাপার। রাজ্য সরকার তো এ বার রামনবমীতে ছুটিও ঘোষণা করেছে।’
শিলিগুড়ির মেয়র গৌতম দেব বলেন, ‘আমি আমার মতো করে রামনবমীর মিছিলে হেঁটেছি। আর কে, কার পাশে রামনবমীর মিছিলে হেঁটেছেন, জানি না।’ তবে এ দিন গেরুয়া ব্রিগেড ও তৃণমূলের রামনবমী উদ্যাপনের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য চোখে পড়েছে রাজনৈতিক মহলের। তৃণমূলের শোভাযাত্রাগুলিতে কোথাও অস্ত্রের ঝঙ্কার শোনা যায়নি। অন্যদিকে, বিজেপি নেতারা যে শোভাযাত্রাগুলিতে ছিলেন, তার অনেকগুলিতেই অস্ত্র থাকার অভিযোগ উঠেছে।
হাওড়া শহরে এ দিন দুপুরে একটি ধর্মীয় সংগঠনের উদ্যোগে শোভাযাত্রা বেরোয়। সেখানে বেশ ক’জন বিজেপি নেতাকে অস্ত্র হাতে হাঁটতে দেখা যায়। রামভক্তদের অনেককেই সেখানে খোলা তলোয়ার হাতে দেখা যায় বলে অভিযোগ। অর্জুন সিংয়ের খাসতালুক ভাটপাড়াতেও শোভাযাত্রায় ছিল অস্ত্রের ঝনঝনানি। এবং তাতে হাজির ছিলেন ব্যারাকপুরের বিজেপি প্রার্থী অর্জুনও।
মালদা দক্ষিণ কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী শ্রীরূপা চৌধুরীর নেতৃত্বে এ দিন যে শোভাযাত্রা বেরিয়েছিল, সেখানেও অনেককে অস্ত্র হাতে হাঁটতে দেখা যায় বলে অভিযোগ। আদালতের নির্দেশ ভেঙে কী ভাবে অস্ত্র-মিছিল হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ বলেন, ‘রামচন্দ্রের হাতে কোনও ধারালো অস্ত্র কেউ কোনওদিন দেখেনি। ভগবান রামকে শ্রদ্ধা করলে তাঁর পুজো করুন, শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রা করুন। আসল কথা, বিজেপি চাইছে প্ররোচনা দিতে। গত বছর এক বিজেপি নেতা রামনবমীর শোভাযাত্রায় হাতে অস্ত্র নিয়ে ঘুরেছিলেন।’
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য আগেই অভিযোগ করেন যে রামনবমীর দিন ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা করবে বিজেপি। এ প্রসঙ্গে বিজেপি সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘নিয়ম মেনেই রামনবমী পালন করেছি আমরা। কিন্তু বীরভূমে আমাদের প্রার্থীকে শোভাযাত্রায় হাঁটতে বাধা দেওয়া হয়। ঝাড়গ্রামের প্রার্থীকে তৃণমূল কদর্য ভাষায় আক্রমণ করেছে। যেমন ওরা এতদিন ভগবানকে রামকে আক্রমণ করেছে।’