এই সময়: কথায় বলে, 'সে রামও নেই। সে অযোধ্যাও নেই!' তবে ঘটনাচক্রে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে এই দু'টি ফ্যাক্টর আবার হিন্দি বলয়ে ভালোই আছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক সমীক্ষকদের একাংশ। তবে এখানে যে কারণে 'রাম ও অযোধ্যা'র উল্লেখ, তার কারণ আলাদা। এক সময়ে তামিলনাড়ু ভোটের সঙ্গে সমার্থক ছিল 'গ্র্যান্ড সেলিব্রেশন।'হেঁটে হেঁটে প্রচার হোক বা গাড়িতে রোড শো, বা বিজয়োল্লাস - সব দিক থেকেই তামিল-ভূম ছিল ইউনিক। সৌজন্যে, 'আম্মা' জয়ললিতা ও 'কলাইনার' করুণানিধি। তাঁদের নেতৃত্বাধীন দুই দল - এআইএডিএমকে ও ডিএমকে পাল্লা দিত জাঁক-জমকে কে কাকে ছাপিয়ে যাবে! দু'জনেই প্রয়াত। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের আগেই দুই নেতার মৃত্যু হয়েছিল। তবে, সে বার তার নিজস্ব 'রং' হারায়নি তামিলনাড়ু।
কিন্তু এ বারের ভোট একেবারেই অন্যরকম, অন্তত দক্ষিণী রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের বড় অংশের দাবি তেমনই। তাঁরা মনে করছেন, হয়তো বিরাট কোনও অঘটন ঘটবে না। তবে গেরুয়া রং যতটা ফিকে ছিল, তা থাকবে না। কোনও কোনও জায়গায় পদ্মফুল ফুটলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
কী থেকে এমন ভাবনা? প্রধানমন্ত্রী মোদীর বারবার ওই রাজ্যে গিয়ে রোড শো করা, জনসভায় তামিল সেন্টিমেন্ট উস্কে দেওয়া এমনকী তাঁদের 'ভূখণ্ড' কচ্চাতিবুকে ১৯৭৪ সালে শ্রীলঙ্কাকে ইচ্ছাকৃত ভাবে দিয়ে দিয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার বলে তাঁদের আঞ্চলিক গৌরবকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা - কোনও কিছুতেই ত্রুটি রাখেননি প্রধানমন্ত্রী।
সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে মোদীকে বলতে শোনা গেছে - ভারত বৈচিত্রে ভরা। এখানে মরুভূমিও আছে, সমুদ্র সৈকত, পাহাড় আছে। গঙ্গাও আছে। আছে কাবেরীও। তাই ভারতকে 'টুকরো' আকারে দেখা আসলে দেশকে বুঝতে না পারার লক্ষণ। ভগবান রামের নাম রয়েছে এমন গ্রামের সংখ্যা তো সব চেয়ে বেশি তামিলনাড়ুতেই। আপনি একে কী ভাবে ব্যাখ্যা করবেন?'
রাজনৈতিক মহলের অভিমত, এ বার তামিলনাড়ুতে পদ্ম ফোটাতে এতটাই মরিয়া মোদী যে ভগবান রামকে যে তামিলনাড়ু পেরিয়েই সীতাকে উদ্ধার করতে লঙ্কায় যেতে হয়েছিল, তা তিনি বোধহয় বিস্মৃত হয়েছেন। কথিত আছে, দুই দেশের মধ্যেকার সমুদ্র পেরনোর জন্য তিনি পাথর ফেলে সেতুবন্ধন করেছিলেন, যা আজকের 'সেতুবন্ধন রামেশ্বরম' নামে পরিচিত! কাজেই সেই রাজ্যের গ্রামের নামে 'রাম' থাকায় তাঁর আশ্চর্য হওয়ায় অনেকেই বেশ অবাক হয়েছেন।
এত সবের পরেও কি বিজেপি পারবে স্ট্যালিনের ডিএমকে-কে পরাস্ত করতে? মোদী যত ভাবে উদয়নিধির 'সনাতন ধর্ম' টেনে এনে ডিএমকে-কে 'হিন্দু বিরোধী' বলে দাগিয়ে দিতে চেয়েছেন, ভোটারদের মন জিততে জাত্যভিমানকে হাতিয়ার করেছেন, তার পরেও কিন্তু দেখা যাচ্ছে সব জায়গায় গেরুয়া হাওয়া নেই। এডিএমকে অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে এখন তিন ভাগ, সেখানে এখন ডিএমকে ও জোটসঙ্গী কংগ্রেসের সামনে চ্যালেঞ্জের নাম ভারতীয় জনতা পার্টি। সেই দলকে তামিলভূমের মানুষ কতটা আপন করে নেবে তা সময় বলবে।
তবে সেখানকার স্থানীয় মানুষজন কিন্তু একটা ব্যাপারে এককাট্টা - সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও তাঁদের মাতৃভাষা। আর অনেক বিশ্লেষক বিপদ দেখছেন এখানেই। তাঁরা মনে করছেন, এই রাজ্যের মানুষ বারবার দেখেছেন কী ভাবে তাঁদের উপরেও হিন্দি চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় সরকার। এমনকী নতুন যে ফৌজদারি আইন আনা হয়েছে সেগুলোর নামকরণও হিন্দিতে!
এই নিয়ে স্ট্যালিন-সরকারই প্রতিবাদ করেছিল। তাঁরা এ-ও দেখছেন কেমন ভাবে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে তাঁদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয়। এই রাজ্য সব সময়েই আঞ্চলিক ভাবে ভোট দিয়ে এসেছে। তাই 'মাইগ্রেটরি মোদী' কতটা এগিয়ে দিতে পারেন তাঁর দলকে, আজ ৩৯ আসনে তা নির্ধারিত করবেন জনতা জনার্দন।