নিখুঁত পরিকল্পনার সঙ্গে মগজাস্ত্রের সঠিক প্রয়োগ। আর এই দুয়ের যুগলবন্দিতে কেঁপে গেল ছত্তিসগড়ের মাওবাদী সংগঠন। মাত্র দুদিন আগে ২৯ জন স্কোয়াড সদস্যকে নিকেশ করে সাম্প্রতিক কালের মধ্যে সবচেয়ে বড় সাফল্য পেল যৌথ বাহিনী। যে সফল অপারেশনকে বলা হচ্ছে, 'ওয়্যার অফ শ্যাডো।'কিন্তু বস্তারের প্রাচীন প্রবাদ বলে, পুরো এলাকায় পুলিশ দু'কদম এগিয়ে থাকলে, মাওবাদীরা সব সময়েই এগিয়ে থাকে চারকদম। তাহলে কাঙ্কেরের ছোটবেটিয়া গ্রামে এমন কী ঘটল, যাতে কার্যত ধসে গেল মাওবাদীদের স্থানীয় সংগঠন? যৌথ বাহিনীর কর্তাদের দাবি, সামান্য কিছু স্ট্র্যাটেজি বদলের জেরে নাজেহাল করে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল শঙ্কর রাও, ললিতাদের মতো মোস্ট ওয়ান্টেডদের।
কী ছিল সেই গোপন স্ট্র্যাটেজি? পুলিশ সূত্রের খবর, বেশ কিছুদিন ধরে স্যাটেলাইটের সাহায্য নিয়ে বস্তারের পাতা ঝরার মরশুমে স্কোয়াড সদস্যদের আনাগোনার উপর নজরদারি করছিলেন বস্তার ফাইটার ফোর্সের সদস্যরা। অনেকটা ভিলেজ পুলিশের আদলে তৈরি করা এই ফোর্সের কর্মীরা প্রত্যন্ত গ্রামে নিজেদের সোর্স তৈরি করে ফেলেছিলেন।
কয়েকদিন আগে সেই খবরিদের(সোর্স) মাধ্যমে জানা যায় কোটরি এবং ভাল্লার নদীর মধ্যে থাকা হাপাতোলা এলাকার ছোটবেটিয়া গ্রামে মাওবাদীদের তরফে জনাতন সরকার (বিনা ভোটে পঞ্চায়েত বাছাই করা) গঠনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। মূল সড়ক থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার ভিতরে থাকা গ্রামটি মাওবাদীরা বেছে নিয়েছিল এই কারণে যে, এর পূর্ব-পশ্চিম এবং উত্তর দিকে রয়েছে গভীর জঙ্গল। ফলে কোনও ভাবে বাহিনী ঘিরে ধরলে যাতে সহজে সেখানে গা ঢাকা দেওয়া যায়।
ছত্তিসগড়ের ডিআইজি(বিএসএফ) আলোক সিং 'এই সময়'-কে বলেন, 'প্রায় পঞ্চাশ জনের একটি দল কোটরি নদীর ধারে মিটিং করার প্রস্তুতি নিয়েছিল। আচমকা চারদিক থেকে এমন আক্রমণ হবে ওরা বুঝতেই পারেনি। সেদিন আমাদের ফোর্সে ছিল ১৮৭ জওয়ান। ফলে সংখ্যার দিক থেকেই ওরা সংখ্যালঘু হয়ে যায়।'
সূত্রের খবর, স্যাটেলাইটে আগাম আভাস পেয়ে লাগোয়া মহেলা, সঙ্গম, কাঠগাঁও সহ একাধিক গ্রামে পায়ে হেঁটে ছোট ছোট দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ফলে এক একটি জায়গায় তিন থেকে পাঁচটি করে ব্যাকআপ ফোর্স জঙ্গলে আগাম পৌঁছে ক্যামোফ্লেজ করে থাকতে শুরু করে। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাহিনীর জওয়ানদের পাখি পড়ার মতো করে বোঝানো হয় যে, গরমে হাঁটতে প্রবল পরিশ্রম হলেও গ্রামের বা আশেপাশের কল বা কুয়ো থেকে জল খাওয়ার চেষ্টা যাতে কেউ না করেন। আগে বহুক্ষেত্রে এভাবে জল খেতে যাওয়া জওয়ানকে দেখে গ্রামে লুকিয়ে থাকা মাওবাদীরা হয় গা ঢাকা দিয়েছেন, নয়তো পাল্টা আক্রমণ করেছেন।
ফলে এবারে প্রত্যেকের জন্য আলাদা করে হালকা জলের পাত্র বরাদ্দ করা হয়, যাতে পিপাসা পেলেও জঙ্গলের অন্দরে কারও সমস্যা না হয়। পাশাপাশি গোয়েন্দারা সিদ্ধান্ত নেন, স্যাটেলাইটে যে রাস্তা মাওবাদীরা ব্যবহার করছেন বলে দেখা যাচ্ছে, সেই রুট ধরে রাতের অন্ধকারে বাহিনীর জওয়ানদেরও জঙ্গলে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে, যাতে তাঁরা রাস্তায় পেতে রাখা প্রেশার মাইনের শিকার না হন। এই দুটি পরিকল্পনা খেটে যেতেই হাপাতোলা এলাকার তিনটি দিকের জঙ্গলে বাহিনীর শক্তিবৃদ্ধি করা হয়। যাতে প্রথম সারির জওয়ানদের ব্রাশ ফায়ারিং শুরু করলেই পালিয়ে যাওয়া মাওবাদীরা পূর্ব-পশ্চিম এবং উত্তর দিকের গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করে।
দেখা যায়, অপারেশন শুরু হতেই ঠিক সেই ফাঁদে পা দিয়েছেন স্কোয়াড সদস্যরা। এরপর চক্রব্যূহে আটকে পড়া মাওবাদী সদস্যদের নিকেশ করা ছিল স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। কারণ, বাহিনীর কর্তারা বিলক্ষণ জানতেন, এতদিন যে ভাবে জওয়ানদের ফাঁদে ফেলে নির্মম ভাবে খুন করা হতো, এবারে নিজেদের সেই প্যাঁচেই জড়িয়ে গিয়েছেন মাওবাদী সদস্যরা। আর এই স্ট্র্যাটেজিতেই ইদানীংকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় সাফল্য অর্জন করে ছত্তিসগড়ের যৌথ বাহিনী।