আড়াই বছর আগের কৃষক-হত্যার দাগ ‘মুছে’ জয়ে আত্মবিশ্বাসী টেনি
এই সময় | ২১ এপ্রিল ২০২৪
অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায়, লখিমপুর খেরি
২০২১-এর ৩ অক্টোবর। কেন্দ্রীয় সরকারের আনা তিনটি কৃষি আইনের বিরুদ্ধে লাগাতার কৃষক-আন্দোলন চলছে। তার মধ্যেই ঘটে গিয়েছিল ভয়াবহ এক ঘটনা। উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর খেরিতে সংযুক্ত কিষান মোর্চার সমর্থনে আন্দোলন করতে গিয়ে সে দিন প্রাণ হারিয়েছিলেন চার জন কৃষক ও একজন সাংবাদিক৷ জিপের তলায় তাঁদের চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল বলে অভিযোগ৷ এই একই ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন দু’জন বিজেপি নেতা ও তাঁদের গাড়ির চালক।পাল্টা অভিযোগ ছিল, কৃষকরা তাঁদের পিটিয়ে মেরেছেন। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রবল চাপে পড়ে গিয়েছিল বিজেপি সরকার৷ বিজেপির ভিতরে ও বাইরে জোরদার দাবি উঠেছিল লখিমপুর খেরির ওই নৃশংস হত্যালীলার দায়ে অভিযুক্ত আশিস মিশ্রর সঙ্গে সাজা দেওয়া হোক তাঁর বাবা প্রভাবশালী বিজেপি নেতা এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনিকে৷ বহু কসরতের পরে গদি রক্ষা করতে পেরেছেন টেনি, আর তাঁর ছেলে লখিমপুর হত্যাকাণ্ডের মূল অভিযুক্ত জামিনে মুক্ত৷
এই ঘটনার আড়াই বছর পরে লখিমপুর খেরিতে পা দিয়ে স্পষ্ট বোঝা গেল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যাবতীয় ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ করে ফেলেছেন টেনি৷ ২০১৪ এবং ২০১৯-এ বড় ব্যবধানে জয়ী হওয়া কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এ বারও এই লোকসভা কেন্দ্র থেকে জেতার আশা করছেন। স্থানীয় বিজেপি সূত্রে দাবি, তাঁকে টেক্কা দেওয়ার মতো কাউকে দূরবীন দিয়েও দেখা যাচ্ছে না।
ফলে, নেপাল সীমান্তের খুব কাছে অবস্থিত উত্তরপ্রদেশের সব থেকে বড় জেলা লখিমপুরের লোকসভা আসন খেরিতে এ বার পরিবর্তনের বদলে প্রত্যাবর্তনের পদ্মই ফুটবে, দাবি গেরুয়া শিবিরের৷
কী ভাবে পরিস্থিতি ‘সামাল’ দিলেন টেনি?
সেখানকার সাধারণ মানুষ জানাচ্ছেন, ২০২১-এর ৩ অক্টোবরের পর থেকে প্রতি সপ্তাহে দিল্লি থেকে লখিমপুরে এসেছেন মন্ত্রীমশাই। বিরোধীরা এমনকি তাঁর দলের কেউ কেউ-ও যখন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে টেনিকে বরখাস্ত করার দাবি তুলছেন ঠিক সেই সময়ে নিজের নির্বাচনী কেন্দ্রে মাটি কামড়ে পড়ে থেকে জনতার ক্ষোভ প্রশমনের জন্য লাগাতার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন অজয় মিশ্র৷
এখানেই শেষ নয়, লখিমপুরের কৃষক হত্যায় অভিযুক্ত তাঁর ছেলে আশিসকে ঘটনাস্থল থেকে দূরে রেখেছেন জামিন পাওয়ার পরেও৷ বাবা না ছেলে — কার প্রতি লখিমপুরের জনতার ক্ষোভ বেশি, তা বুঝতে দেরি হয়নি টেনির৷ সঙ্গে সঙ্গে পদক্ষেপও করেছেন তিনি৷ এখনও তাই জারি রেখেছেন তিনি।
আমাদের গাড়ির চালককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘নিহত কৃষকদের বাড়ি কোথায়? তাঁদের আপনজনকে কোথায় পাব?’ উত্তরটা রীতিমতো অবাক করার মতো, ‘সাব কই বাত নহি করেঙ্গে, মত যাইয়ে উনকে পাস৷’ কথা না বাড়িয়ে থেমে যাই।
নিজের মনে হাঁটতে হাঁটতে দেখা হয় রামবাহাদুরের সঙ্গে। তাঁরা তিন পুরুষ ধরে এখানকার বাসিন্দা। টেনি-প্রভাবের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে বললেন, ‘গত দু’বছরে তিন বার জনতার আদালতের আয়োজন করেছিলেন মন্ত্রীজি৷ এই আদালতে জনতার উপস্থিতিতেই বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়, যেখানে তত্ক্ষণাত্ মানুষের ক্ষোভ বিক্ষোভের মীমাংসা করা হয়৷’
রামবাহাদুরের সংযোজন, ‘অযোধ্যায় রাম মন্দিরের উদ্বোধনের পরে এখানকার বয়স্ক লোকদের নিয়ে অযোধ্যায় রামলালার দর্শন করানো হয়৷ আমরা শুনেছি, এর পিছনেও মন্ত্রীজিরই উদ্যোগ আছে৷’ ২০২১ সালে অক্টোবরে কৃষক হত্যার পরের বছরের সেপ্টেম্বরে আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল লখিমপুর খেরি৷ সেই সময়ে দুই দলিত নাবালিকাকে গণধর্ষণ করে খুন করার অভিযোগ ওঠে৷
উত্তাল হয়ে ওঠে এই বিরাট জনপদ৷ এই ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের মধ্যে তিন জন নিজেদের নাবালক হিসেবে দাবি করে৷ এরা সবাই স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা নেত্রীদের ঘরের ছেলে বলেও অভিযোগ ওঠে৷ সে ঘটনার অবশ্য কোনও ‘প্রভাব নেই।’ কোথাও কোনও আলোচনাই হয় না ঘটনাটি নিয়ে৷
এই পরিস্থিতিতে প্রবল প্রতাপশালী অজয় মিশ্রকে কতটা চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবেন সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী উত্কর্ষ ভার্মা? এলাকায় ঘুরে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টার সময়েই ব্যতিক্রমী ঠেকল জনৈক সপা কর্মী রামেশ্বর পাঠকের বক্তব্য৷ তাঁর প্রশ্ন, ‘যে দেশে একটা লোকের হাতে আইনও বন্দি, সেখানে ভোটের ফলাফল নিয়ে আমজনতার মাথা ঘামানোর কোনও দরকার আছে কি?’
প্রবাদ আছে, ‘সমঝদারো কে লিয়ে ইশারাই কাফি হ্যায়’ — লখিমপুরের দিগন্ত বিস্তৃত একটি আখ ক্ষেতে দাঁড়িয়ে এই প্রবাদ নীতি মেনে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে মনে হলো৷