খাতায়কলমে অ্যাডভোকেট। ল পাশ করে চেম্বারে প্র্যাক্টিসও শুরু করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টে। কিন্তু সওয়াল-জবাবে মন টিকল না। বেশ কয়েক বছর ধরে জঙ্গল আর ক্যামেরা সবচেয়ে প্রিয় সঙ্গী। ডিসকভারি, ন্যাট জিও-তে বেরোয় তাঁর তোলা ছবি। পশ্চিম দিল্লির মেয়ে আরজ়ু খুরানা তাই ঠিক করলেন, দেশের প্রত্যেকটা টাইগার রিজ়ার্ভ ঘুরবেন রোড ট্রিপে। নামী জঙ্গল ছাড়া পর্যটকরা যেতে চান না নতুন কোথাও। আরজ়ুর চ্যালেঞ্জ ছিল, দেশের ৫৫টা টাইগার রিজ়ার্ভই যে নিজস্বতায় অনন্য, সেটা তিনি দেখাবেন।
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল আরজ়ু শেষ করেছেন সেই চ্যালেঞ্জ। দেশের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে গত ৬ মাসে ৫৫টি টাইগার রিজ়ার্ভ চষে ফেলেছেন তিনি। ছত্তিসগড়ে মাওবাদীদের ডেরায় ঢুকে পড়েছেন প্রায়, মিজোরামের জঙ্গলে দিন কেটেছে না-খেয়ে। প্রায় ৩৫ হাজার কিমি পথ পেরিয়ে এখন উত্তরাখণ্ড হয়ে দিল্লি ফিরছেন বছর ২৯-এর আরজ়ু। এখনই ঠিক করে ফেলেছেন, টুকটাক ওকালতি করলেও সুপ্রিম কোর্টে রেগুলার প্র্যাক্টিস আর তিনি করবেন না।আরজ়ুর এই রোড ট্রিপের নাম ছিল ‘অল টাইগার রিজ়ার্ভ’। গত বছর ১ অক্টোবর রাজস্থানের সরিস্কা থেকে শুরু করেছিলেন ‘এটিআর’ যাত্রা। গোটা দেশ ঘুরে ৫৫তম টাইগার রিজ়ার্ভ হিসেবে শুক্রবার উত্তরাখণ্ডের করবেটে যান আরজ়ু। সে রাজ্যের মুখ্য বনপাল পিএম ঢাকেত নিজের এক্স হ্যান্ডলে আরজ়ুর জার্নিকে কুর্নিশ জানিয়ে লিখেছেন, ‘লেসার নোন’ বা লাইমলাইটে কম থাকা টাইগার রিজ়ার্ভগুলি সম্পর্কে সবাইকে জানানোর এমন উদ্যোগ ভারতে এর আগে কেউ নেননি।
আরজু খুরানা
কী ভাবে চলেছে আরজ়ুর এই এটিআর যাত্রা?‘স্বপ্নটা ছেলেবেলার। ভরতপুর বার্ড স্যাংচুয়ারিতে আমার ওয়াইল্ডলাইফ ফোটোগ্রাফির হাতেখড়ি। বড় হয়ে স্বপ্নপূরণ করছি বলা যায়’— বাড়ি ফিরতে ফিরতে ফোনে বললেন আরজ়ু। দিল্লিকন্যার কথায়, ‘সুপ্রিম কোর্টে প্র্যাক্টিস করে খারাপ লাগত না। কিন্তু ওয়াইল্ডলাইফ ফোটোগ্রাফি খুব টানে। এই ট্রিপটার কথা ভেবে অনেকদিন ধরে টাকা জমিয়েছি আর লাইনআপ করেছি।’ এই ট্রিপে কোনও স্পনসর ছিল না আরজ়ুর। বাড়ির লোকজনও প্রথমে রাজি ছিলেন না, পরে মেনে নেন। করবেটের জঙ্গলে প্রায় বছর ২০ কাজের এক্সপেরিয়েন্স থাকা ইরশাদকে ড্রাইভিং সিটে বসিয়ে নিজের ক্যামেরা কিট আর এক ভিডিয়ো এডিটরকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন মিস খুরানা।
হঠাৎ ৫৫টা টাইগার রিজ়ার্ভই কেন?
আরজ়ু বলছেন, ‘দেখবেন, সবাই তাডোবা, করবেট, রণথম্ভোর, কানহা ছোটে। ক’জন পেরিয়ার, সঞ্জয় ন্যাশনাল পার্ক যান? দেশের উত্তর-পূর্বের বাঘের জঙ্গলেই বা ট্যুরিস্ট কই? আমি এই আনকন্ট্রোলড ট্যুরিজ়মকে একটু ডাইভার্ট করানোর চেষ্টা করছি। যে টাইগার রিজ়ার্ভে বাঘ প্রায় নেই, সেখানেও তো দুর্দান্ত অন্য সব বন্যপ্রাণ রয়েছে। তাদের দেখতে তো কেউ যান না। আমি সেই তথ্যগুলোই সামনে আনব। তাতে পর্যটকরাও যেমন উৎসাহ পাবেন, তেমনই ওই কম বেড়ানো এলাকাগুলোর বাসিন্দাদের কাছে ইকো ট্যুরিজ়মের ব্যবসায় ঢোকারও সুযোগ তৈরি হবে। তাতে সবারই লাভ।’
৬ মাসে দেশের ৫৫ টি টাইগার রিজার্ভ চষে ফেলেন আরজু
৩৫ হাজার কিলোমিটার ইতিমধ্যেই আরজ়ু পাড়ি দিয়েছেন তাঁর ‘হাইলাক্স’ এসইউভিতে। দিল্লিতে বাড়ি ফেরার সময়ে সেটা হয়তো ৪০ হাজার ছোঁবে। ভয় করেনি এতটা রাস্তা এ ভাবে পাড়ি দিতে?
আরজ়ুর স্পষ্ট জবাব, ‘ভয় যথেষ্টই হয়েছিল একবার। ছত্তিসগড় ঢুকে আমরা গিয়েছিলাম ইন্দ্রাবতী টাইগার রিজ়ার্ভে, যেটা বস্তার থেকে আধঘণ্টা দূরে। ওখানে কেউ যায় না। সেখানে বসে গ্রামবাসীদের থেকে শুনেছিলাম, ‘ডিসটার্বড’ এরিয়ায় কোথা থেকে কখন শেলিং হবে, কেউ জানে না! মিজোরামে ডাম্পা টাইগার রিজ়ার্ভে পৌঁছনোর পথ যথেষ্ট দুর্গম। ট্যুরিস্ট নেই, সাফারি হয় না। থাকার জায়গা বলতে ছিল ফরেস্টের বাঁশের ঘর, যার ছাদ চুঁইয়ে সারা ক্ষণ জল পড়ত। আমি ভেজিটেরিয়ান। মিজোরামে জঙ্গল এরিয়ায় না-খেয়ে থাকার অভিজ্ঞতাও হয়েছে। আবার পেরিয়ারের ওয়াচ টাওয়ারে বসে মধ্যরাতে সজারুদের দাপাদাপিও দেখেছি।’
আরজ়ুর ইচ্ছে, পর্যটকরা সব টাইগার রিজ়ার্ভে যান। সেখানকার বন্যপ্রাণ দেখুন, আশপাশের গ্রামের মানুষ-সংস্কৃতির খোঁজ নিন। তবেই পুষ্ট হবে জঙ্গল। ট্র্যাফিক জ্যামের মতো সাফারির লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে বাঘ দেখাই একমাত্র সার্থকতা নয়।