২০১৬-র বিধানসভা ভোটের সময়ে অন্য একটি কারণে খবরের শিরোনামে উঠে এসেছিলেন রাজ্যের দুই হেভিওয়েট মন্ত্রী। অভিন্ন সেই কারণ হলো, গলা ভেঙে যাওয়া৷ ভোট প্রচারের মধ্যে বসে যাওয়া কণ্ঠের স্বর তুলতে তাঁরা ডাক্তারবাবুর দ্বারস্থ হন৷ এ বার লোকসভা নির্বাচনের মরশুমেও এমন নজির বিরল নয় বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা। ২০১৬-তে যে ইএনটি বিশেষজ্ঞের চেম্বারে ওই দুই মন্ত্রী গিয়েছিলেন, তিনি বলছেন, ‘নিয়ম না-মানলে গলা বাঁচানো মুশকিল৷ বিশেষ করে, এই সময়টায়।’ ভোটের বাজার মানেই ভোটের প্রচার৷ আর ভোটের প্রচার মানেই বিস্তর গলাবাজি।
জনসভা হোক বা ভাষণ বা কর্মিসভা — নেতা ও প্রার্থীদের অনর্গল উচ্চস্বরে কথা বলতেই হয়৷ সামনে লাউডস্পিকার থাকুক বা না থাকুক, অনর্গল উচ্চস্বর থেকে নিস্তার নেই নির্বাচনী প্রচারে। যার জেরে স্বরযন্ত্র প্রদাহের শিকার হয়ে গলার বারোটা বাজার সমূহ আশঙ্কা। তাই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ — জোরে বলুন। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো গলার পিচ যত কম ওঠানামা করে, ততই মঙ্গল। পিচ ঘনঘন চড়ায় তুললে বা খাদে নামালে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় স্বরতন্ত্র।
চিকিৎসকরা বলছেন, প্রচারে গলাবাজি করেও গলা বাঁচাতে চাইলে কিছু টোটকা মেনে চলতেই হবে৷ না হলে গলা বসা, গলা ভাঙা থেকে ব্যথা, প্রদাহ, এমনকী সংক্রমণ, রক্তক্ষরণও বিচিত্র নয়৷ এর অজস্র নজিরও রয়েছে৷ যাঁরা রাজনীতির ময়দানে একেবারে আনকোরা, তাঁদের ক্ষেত্রেই সমস্যাটা বেশি৷ মিটিং-মিছিল-জনসভা-কর্মিসভার অভিজ্ঞতা এঁদের একেবারে নতুন৷ ছাত্র বা যুব রাজনীতি করে উঠে আসা রাজনীতিকদের তুলনায় গলাবাজির অভ্যাসে তাঁরা অনেকটাই পিছিয়ে।গণতন্ত্রের লড়াইয়ে স্বরযন্ত্রের বারোটা
ইএনটি বিশেষজ্ঞ সুবীর হালদার মূলত এঁদের সাবধান করে বলছেন, ‘গলাকে প্রয়োজনীয় বিশ্রাম না-দিয়ে অনর্গল জোরে কথা বলার অর্থই হল স্বরতন্ত্রী বা ভোকাল কর্ডকে চাপে ফেলা৷ গুরুত্ব না-দিলে সমস্যা বাড়বে৷ উচ্চস্বরে লম্বা কথা বলার মধ্যে ১০-১৫ মিনিটের বিশ্রাম একান্ত জরুরি৷’ তাঁর পরামর্শ, মাঝেমধ্যে জল খেয়ে স্বরতন্ত্রীর আর্দ্রতা বজায় রাখতে হবে৷ না-হলে, গলা খুসখুস বা কাশি দিয়ে শুরু হয়ে গলার প্রবল সমস্যা দেখা দিতে পারে৷
সুবীরের মতে, আনকোরাদের সমস্যা বেশি হলেও, রাজনীতির জগতে পোড়খাওয়া দুঁদে নেতাদেরও অনেকে এতে জেরবার৷ তাই ন্যূনতম সাবধানতা বজায় রাখতেই হবে৷ এসএসকেএমের ইএনটি বিভাগের প্রাক্তন প্রধান চিকিৎসক অরুণাভ সেনগুপ্তের মতে, ‘প্রচারে নেতা ও প্রার্থীদের সকলকেই বিস্তর গলা ফাটাতে হবে। যাঁরা রাজনীতিতে নবাগত, অনভ্যাসকে অগ্রাহ্য করে তাঁদেরও গলা ফাটাতে হবে অনেক৷ কাজেই, তাঁদের ক্ষেত্রে দ্রুত বিপত্তি বাধবেই।’
আর এক ইএনটি বিশেষজ্ঞ দ্বৈপায়ন মুখোপাধ্যায়ও মনে করেন, ‘ক্রমাগত আঘাত সহ্য করতে থাকলে ভোকাল কর্ডের স্বাভাবিক কাজকর্মের অবনতি হতে হতে এক সময়ে তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়৷ তার আগে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়ে ফেললে সমস্যা নেই৷’ দীর্ঘক্ষণ জোরে কথা বললে ভোকাল কর্ডে যে চাপ পড়ে আর ঘর্ষণ হয়, তাতে শুকিয়ে যায় স্বরতন্ত্রী৷ তখনই ভোকাল কর্ডের পেশি আর তন্তুগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে বলে বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন৷ স্বরতন্ত্রীর মধ্যে সর্ষেদানার মতো নোডিউল তৈরি হয়ে গলা বসা, ভেঙে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়৷
পরে সেটাই বিশ্রামের অভাবে বাড়তে বাড়তে মারাত্মক প্রদাহ, রক্তক্ষরণ, সংক্রমণের পর্যায়ে পৌঁছয়৷ অরুণাভর মতে, সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো বারবার চড়া আর খাদের মিশ্রণ৷ বরং একস্বরে জোরে কথা বললেও অনেকক্ষণ চালিয়ে যাওয়া যায়, ক্ষতিও কম হয়৷ তাঁর প্রেসক্রিপশন— ‘এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সকলের আদর্শ হওয়া উচিত৷ নরেন্দ্র মোদীর মতো চড়া আর খাদের নাটকীয়তা বজায় রেখে টানা কথা বলে গেলে গলা ভাঙে তাড়াতাড়ি। এতে স্বরযন্ত্রের পেশি আর তন্তুর পরিশ্রম অনেকটা বাড়ে। ফলে দ্রুত প্রদাহের শিকার হয়ে পড়ে ভোকাল কর্ড।’