এই সময়: বেনজির রায়ে একলপ্তে এসএসসি-র প্রায় ২৬ হাজার নিয়োগ বাতিলের নির্দেশের সপক্ষে একটি যুক্তি হিসাবে কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে-বেআইনি নিয়োগের মোট সুবিধাভোগীর সংখ্যাটা এখনও অজানা। এবং এক্ষেত্রে রাজ্য-এসএসসি-মধ্যশিক্ষা পর্ষদ যে সব যুক্তি দিয়েছে, তা অবাস্তব বলে মনে হয়েছে আদালতের।কিন্তু তারপরেও যে প্রশ্নটা চাকরিপ্রার্থী, আইনজীবী, প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে আমজনতার মধ্যে ঘোরাফেরা করছে, সেটা হলো-সিবিআই ওএমআর শিট খতিয়ে দেখে যারা দুর্নীতি করেছে বলে আদালতে প্রাথমিকভাবে জানিয়েছিল, তাদের সঙ্গে বাকিদের সবার চাকরিই কোর্ট খারিজ করে দিল কেন?
তাহলে এখনও পর্যন্ত সিবিআই তদন্তে যে চাকরিপ্রাপকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল ওঠেনি, তাঁরাও তো অথৈ জলে পড়লেন। তাঁদেরও তো সামাজিক সম্মান চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করতে গিয়ে 'কোল্যাটারাল ড্যামেজ'-এ কি যোগ্য প্রার্থীরাও চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে গেলেন না-এই প্রশ্নটাও জোরালোভাবে উঠছে।
হাইকোর্টের রায় চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার কথা ইতিমধ্যেই জানিয়েছে এসএসসি ও রাজ্য সরকার। সিবিআই যাঁদের বিরুদ্ধে এখনও অভিযোগের আঙুল তোলেননি, সেই 'যোগ্য' চাকরিপ্রাপকরাও এবার এই রায়ের বিরুদ্ধে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার কথা জানালেন। মঙ্গলবার কলকাতা, বালুরঘাট, বহরমপুর, শিলিগুড়ি-সহ রাজ্যের নানা প্রান্তে এই 'যোগ্য' শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীরা প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন।
হাইকোর্টের নির্দেশে চাকরি খুইয়ে অনেকেই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। এদিন সন্ধ্যায় এই চাকরিপ্রাপকদের পাঁচ সদস্যের এক প্রতিনিধি দল মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেন। কীভাবে এসএসসি-র নিয়োগে বেনিয়ম হয়েছে এবং কেন গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়াটাকেই অবৈধ বলে মনে করছে আদালত-তার ব্যাখ্যা রায়ে জানিয়েছে হাইকোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাক ও বিচারপতি সব্বর রশিদির নেতৃত্বাধীন স্পেশাল বেঞ্চ।
কিন্তু তারপরেও এই চাকরিহারা এবং আইনজ্ঞদের একাংশের যুক্তি, গাজিয়াবাদ থেকে উদ্ধার হওয়া হার্ডডিস্কে মেলা ওএমআর শিট পরীক্ষা করে সিবিআই আদালতে প্রাথমিকভাবে জানিয়েছিল, পৌনে সাত হাজার ওএমআর শিটে জালিয়াতি করে নিয়োগ হয়েছে। প্যানেল থেকে নিয়োগ পাওয়া বাকি ১৯ হাজার জনের ক্ষেত্রে তদন্তকারী সংস্থা কিছু জানায়নি। ফলে ধরেই নেওয়া যায়, তাঁরা 'যোগ্য' চাকরিপ্রাপক।
বর্ষীয়ান আইনজীবী প্রতীক ধরের বক্তব্য, 'রায় দেখে মনে হচ্ছে, আসলে আদালত রাজ্য এবং এসএসসি পর্যাপ্ত তথ্য দিতে পারেনি-এই যুক্তিতে গোটা নিয়োগ বাতিল করাটাই শ্রেয় বলে মনে করেছে। কিন্তু যাঁরা প্রকৃতই যোগ্য হিসেবে চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের কথা ভেবে ডিভিশন বেঞ্চ যদি সিবিআইকে আরও তদন্ত করে আর কারা বেআইনিভাবে চাকরি পেয়েছেন, সেই সংখ্যাটা জানার চেষ্টা করত, তা হলে হয়তো এই রায়কে প্রশ্নের মুখে পড়তে হতো না।'
বিতর্কিত চাকরিপ্রার্থীদের হয়ে আদালতে সওয়াল করেছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল জয়ন্ত মিত্রও। বর্ষীয়ান এই আইনজীবী এদিন বলেন, 'কিছু লোক হয়তো দুর্নীতি করে চাকরি পেয়েছেন। তার জন্য সকলের চাকরি কেড়ে নেওয়া মনে হয় না যুক্তিযুক্ত। এটা তো মুড়ি-মিছরির এক দর হয়ে গেল! যদিও বিচারপতির কাছে এ ব্যাপারে কী তথ্যপ্রমাণ ছিল, তার সবটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আর এক বর্ষীয়ান আইনজীবীর যুক্তি, 'মোট ২৩ লক্ষ পরীক্ষার্থী এসএসসি-র চারটি স্তরে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে সবার ওএমআর শিট সিবিআই এখনও পরীক্ষা করে দেখেনি। তাহলে সিবিআইয়ের কাছ থেকে পুরো রিপোর্ট না-চেয়ে আদালত কীভাবে সবার চাকরি একসঙ্গে খারিজ করে দিল?'
যদিও হাইকোর্টের রায় বিশ্লেষণ করে বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের আইনজীবী সুদীপ্ত দাশগুপ্ত যুক্তি দিচ্ছেন, 'আদালত স্পষ্ট বলেছে, এই নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরুর জন্য নাইসা নামে যে সংস্থাকে বন্ধ ঘরে বাছাই করা হয়েছিল, সেই প্রক্রিয়াটাই অস্বচ্ছ। আবার ওই সংস্থা এই কাজের জন্য তৃতীয় একটি সংস্থাকে নিয়োগ করেছিল। সেটাও আইনিভাবে করা যায় না। ফলে সেই সংস্থা যদি কোনও গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়ার দায়িত্বে থাকে, তাহলে তো এসএসসি-র গোটা নিয়োগটাই ত্রুটিপূর্ণ। তাই আদালত গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়াই বাতিল করেছে।'
আবার প্রবীণ আইনজীবীদের একাংশের পাল্টা প্রশ্ন, রাজ্যের মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাপার দায়িত্ব কাদের দেওয়া হবে, গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থেই সেটা বদ্ধ ঘরে হয়ে থাকে। এসএসসি-র নিয়োগের ক্ষেত্রেও তেমনই করা হয়েছে। তা হলে এক্ষেত্রে নাইসাকে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টিকে কোর্ট গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিলের ক্ষেত্রে মূল গলদ হিসেবে ধরল কেন?
এর পাল্টা ব্যাখ্যা হিসাবে মামলাকারীদের তরফে এক আইনজীবীর যুক্তি, 'সিবিআই যে ওএমআর জালিয়াতির তথ্য দিয়েছিল, হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চে এসএসসি সেই তথ্য মেনে নিলেও সুপ্রিম কোর্ট এবং হাইকোর্টের স্পেশাল ডিভিশন বেঞ্চে তারা তা মানতে চায়নি। উল্টে সিবিআইয়ের ওই নথি কতটা গ্রহণযোগ্য, সেই আইনি প্রশ্ন তুলে দিনের পর দিন আদালতকে অসহযোগিতা করেছে। ফলে আদালত বাধ্য হয়েই সব নিয়োগ বাতিল করে দেয়।'
এসএসসি-র চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মজুমদার অবশ্য এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর কথায়, 'আদালতের নির্দেশে সিবিআই দেড়-দু'বছরের তদন্তে যে কয়েক হাজার চাকরিপ্রার্থীর নিয়োগ সঠিক পথে হয়নি বলে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে রিপোর্ট জমা দিয়েছিল, সেটা কমিশনও ভেরিফাই করেছে। তাতে মামলাকারীর আইনজীবীরাও ছিলেন। এঁদের নিয়োগে ভুল বা দুর্নীতি যাই হোক না কেন, তার মাশুল বাকি ১৯-২০ হাজার দেবে কেন? সমস্ত আদালতে আমরা একই তথ্য দিয়েছি।'