যাতায়াতে ১৪০ কিমি পথ। প্রতিদিন অতটা পথ পেরিয়ে স্কুলের চাকরি করে বাড়ি ফিরে ঋণ শোধের হিসেব কষতেন পূর্বস্থলীর কাঁকনাইলের খোকনলাল বিশ্বাস। বাড়ি তৈরি আর মায়ের চিকিৎসায় বাজারে প্রচুর ধার-দেনা। পাওনাদারদের তাগাদায় শেষে বাড়িই বিক্রি করতে হয়েছে তাঁকে। এখন ঠিকানা ভাড়াবাড়ি। সেই খোকনলাল বিশ্বাসই করতে পারছেন না, তাঁর স্কুলের চাকরি আর নেই।২০১৬-র এসএসসি পরীক্ষায় পাশ করে গ্রুপ ডি পদে চাকরি পেয়েছিলেন বাংলায় অনার্স গ্র্যাজুয়েট খোকনলাল। ২০১৮ সালের ২৩ এপ্রিল কালনা ১-এর তেহাট্টা হাই স্কুলে চাকরিতে যোগ দেন তিনি। তখন তাঁর বয়স ৩৫। বেশি বয়সে চাকরি পেলেও ছোটবেলা থেকে অভাবের সঙ্গে বেড়ে ওঠা খোকনলাল স্বস্তি পেয়েছিলেন। সোমবার হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায়ে এখন তাঁর মাথায় হাত।
মাধ্যমিকের সময়ে বাবাকে হারান খোকনলাল। মায়ের খেতমজুরির উপার্জনে সংসার চলত। বাধ্য হয়ে কম বয়সেই টিউশন শুরু করেন তিনি। তার কিছু পরেই স্ট্রোকে আক্রান্ত হন মা। ৬ বছর শয্যাশায়ী থেকে ২০১২ সালে মৃত্যু হয় মায়ের। বলেন, ‘প্রচুর পরিশ্রম করে পড়াশোনা করতে হয়েছে আমাকে। স্কুলের চাকরিটা একটু স্বস্তি দিয়েছিল। মা যখন শয্যাশায়ী হলেন, তখন পুরোদস্তুর টিউশন করি। বাড়িতে থাকতেই পারতাম না। মাকে দেখার জন্য অল্প বয়সেই বিয়ে করতে হয়। আমার ছেলে সদ্য স্নাতক হয়েছে, মেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে।’
মায়ের সঙ্গে এক ভাগ্নিরও চিকিৎসা করতে হয়েছিল তাঁকে। তার জন্য ঋণ তো ছিলই এর সঙ্গে চাকরি পাওয়ার পর বাড়ি তৈরি করতে গিয়ে সেই বোঝা আরও চেপে বসে। শেষে পাওনাদারদের চাপে ঋণ শুধতে বছর দুয়েক আগে বিক্রি করে দিতে হয় বাড়ি। এখন মাসিক চার হাজার টাকায় ভাড়াবাড়িতে থাকেন খোকনলাল।
খোকনলাল জানান, লিখিত পরীক্ষায় ৪৫-এর মধ্যে তিনি পেয়েছিলেন ৪৩। আর ইন্টারভিউয়ে পাঁচ এর মধ্যে সাড়ে তিন। বলেন, ‘হাই কোর্টের রায়ের পর সব কিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। রায় ঘোষণার সময়ে আমি বাড়ির বাইরে ছিলাম। টিভিতে দেখে স্ত্রী আমাকে জানায়। তার পর থেকে সবাই খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।’
বিচারকের কাছে তাঁর প্রশ্ন, ‘আপনি সোমা দাসের চাকরিটা বহাল রেখে মানবিকতার পরিচয় দিয়েছেন। আপনি এসে দেখে যান যোগ্যতার সঙ্গে যাঁরা আমার মতো চাকরি পেয়েছেন, তাঁরা সোমা দাসের থেকেও কী করুণ অবস্থায় রয়েছেন।’ বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘একটা গ্রামে ১০ জন চোর আছে। আপনাদের সিস্টেম তাদের ধরতে না পেরে পুরো গ্রামটাকেই চোর বলে ঘোষণা করে তাড়িয়ে দিল। এটা তো বিচার ব্যবস্থা হতে পারে না।’
এখনও কাঁধে ঋণের বোঝা নিয়ে চলছেন খোকনলাল। বলেন, ‘বাড়ি করে এমনিতেই প্রচুর দেনা হয়েছে। মাসমাইনে না পেলে খাবারই জুটবে না। এবার তো কিডনি বিক্রি করতে হবে। শুধু আমার নয়, ছেলেমেয়েরও কিডনি বিক্রি করতে হবে। বিচারক সেই জায়গাটা বলে দিন কোথায় বিক্রি হবে। আমরা বিক্রি করে দেব।’
বিচার ব্যবস্থার প্রতি তাঁর প্রশ্ন, ‘আপনাদের সিস্টেম যোগ্য অযোগ্যদের আলাদা করতে পারবে না, সেই দোষ কি আমাদের? দোষ না করেও সাজা পেলাম। আপনি আমাদের দোষী প্রমাণিত করুন। নির্দোষ অবস্থায় কেন সাজা ঘোষণা করবেন?’ ক্ষিপ্ত খোকনলালের পাল্টা তির আদালতের দিকেই।