এই সময়: একটা চলতি প্রবাদ আছে - পহলে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী! তাই নিজের রাজ্যের দশম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষায় প্রথম হয়েও বছর ১৫-র প্রাচী নিগমকে অনলাইনে শিকার হতে হলো ট্রোলিং-এর। স্রেফ ওই মেয়েটির 'লুকস'-এর জন্য! কেন না আর পাঁচটা কিশোরীর মতো প্রাচী নিজের 'সৌন্দর্য' নিয়ে মাথা ঘামায়নি, ফলে তার মুখে রয়েছে ফেশিয়াল হেয়ার।অর্থাৎ সে তার অবাঞ্ছিত 'গোঁফ' কামিয়ে ফেলেনি, মুখের অন্যত্রও যেখানে চুলের আধিক্য - সেগুলোও সে অবস্থাতেই রয়েছে। আর তাতেই নেট দুনিয়ার 'সুন্দরের পূজারী'রা যে যা পেরেছেন কিশোরীকে উদ্দেশ করে লিখে গেছেন! সম্ভবত, একবারও তাঁদের মনে হয়নি, এর ফলে মেয়েটি মানসিক আঘাত পেতে পারে। তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে নিয়ে হাসাহাসি হচ্ছে, তা দেখে সে মর্মাহত হতে পারে।
তবে এমন নয় যে নেট-দুনিয়ার সকলেই 'টক্সিক বিউটি'র ডেফিনিশনে গা ভাসিয়ে প্রাচীকে নিয়ে নানা টিকা-টিপ্পনি করছেন, অনেকেই মেয়েটির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এবং ট্রোলারদের 'সঙ্কীর্ণ মানসিকতার' তীব্র নিন্দা করে তাঁদের একহাত নিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, এই বয়সি একটি মেয়ের যাবতীয় আগ্রহ পড়াশোনায়, নিজের বাহ্যিক রূপ নিয়ে তার কোনও আগ্রহই নেই অর্থাৎ সে এই কিশোরী-বেলাতেও গা ভাসায়নি তথাকথিত 'সৌন্দর্য'-এর সংজ্ঞায় - তা তো তারিফযোগ্য। সে জায়গায় তাকে ট্রোল করা হচ্ছে!
কন্যার এই সাফল্যে গর্বের শেষ নেই তার মা-বাবার। উত্তরপ্রদেশ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড সম্প্রতি ক্লাস ১০ ও ১২-এর রেজাল্ট প্রকাশ করেছে। প্রাচী সেখানে ৬০০-র মধ্যে ৫৯১ পেয়ে (৯৮.৫০ শতাংশ নম্বর) পেয়ে সারা রাজ্যে প্রথম হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড প্রাচীর ছবি প্রকাশ করে। ব্যস, তার পর থেকেই কিছু মানুষ মেতে উঠেছেন প্রাচীর 'রূপ' নিয়ে। তাঁদের মোটেই মনে হয়নি যে মেয়েটি কোন পর্যায়ে পরিশ্রম করে রাজ্যে প্রথম হয়েছে।
কারও মনে হয়েছে, 'গোঁফটা কেটে ফেলতে পারত তো!' আবার একজন প্রাচীর অরিজিনাল ছবি ও ফোটোশপড ছবি পোস্ট করে লিখেছেন - বিফোর অ্যান্ড আফটার ব্রেক আপ! এক জন আবার এ-ও বলেছে, 'এ রকম ছেলে-ছেলে দেখতে হলে, পড়াশোনার রেজ়াল্ট কি কোনও কাজে আসবে!' কারও মনে হয়েছে, 'প্রাচী ছেলে হতে হতে মেয়ে হয়ে গেছে!' আবার কেউ কেউ তাকে নিয়মিত ফেশিয়াল করে নিয়মিত শেভিং-এর পরামর্শ দিয়েছেন।
এমনও আছে, যাঁরা মেয়েটিকে 'লেজ়ার থেরাপি' করিয়ে 'সারা জীবনের মতো দুশ্চিন্তামুক্ত হওয়ার' পরামর্শ দিয়েছেন। অনেকেই জানেন, হরমোন ইমব্যালেন্সের কারণে কোনও কোনও মহিলার শরীরে ও মুখে লোমের আধিক্য থাকে। আবার পিসিওএস ও পিসিওডি থাকলেও এ ধরনের অবাঞ্ছিত লোম থাকা অস্বাভাবিক নয়। প্রাচীরও হয় তো তেমন কিছু থেকে থাকবে। ফলে, প্রকৃত কারণ না জেনেই, অনেকে কদর্য মন্তব্য করতে থাকেন নেট মাধ্যমে।
সেটা এক সময়ে মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। তখনই এগিয়ে আসেন কিছু মানুষ, যাঁরা মেধাবী মেয়েটির পাশে দাঁড়ায়। যথেষ্ট কড়া ভাবে একাধিক ব্যক্তি লেখেন, 'লজ্জা করে না এ সব বলতে! মেয়েটির রেজ়াল্ট দেখেছেন? পারবেন ওর সঙ্গে পাল্লা দিতে? কোন মুখে কথা বলছেন?' আবার এক জন লিখেছেন, 'আমি তো প্রাচীর ছবিটা সে ভাবে খেয়ালই করিনি। যখন দেখলাম এক্স হ্যান্ডেল ভরে গেছে এই কিশোরীর 'রূপ' নিয়ে, তখন দেখলাম। অর্থহীন ট্রোলিং।'
অনেকেই প্রাচীর উদ্দেশে লিখেছেন, 'এ সব কথাকে যে তোমার মতো বুদ্ধিমতী মেয়ে পাত্তা দেবে না, জানি। তুমি এগিয়ে চলো। তোমার পাশে আছি। অনেক শুভেচ্ছা।' এক জন নিজেকে সাইকো-সোশ্যাল এক্সপার্ট পরিচয় দিয়ে লিখেছন, 'অবাক হয়ে যাচ্ছি যে মেয়েটাকে ট্রোল করা হচ্ছে। অথচ টিন-এজে মেয়েরা সাধারণত শরীর ও রূপ সচেতন হয়। সে যাতে অন্যকে আকর্ষণ করতে পারে, সে জন্য নিজেকে 'সুন্দর' রাখতে চায়। তাই ফেশিয়াল করা, ব্ল্যাক হেডস রিমুভ করা, ওয়াক্সিং, ফেস মাসাজ, ফেশিয়াল হেয়ার রিমুভাল কিশোরীরা করেই থাকে, যা থেকে প্রাচীর চিন্তা-ভাবনা আলাদা। সেটা তো শিক্ষণীয় যে ও চিরাচরিত সৌন্দর্যের সংজ্ঞা নিয়ে মাথা ঘামায়নি।'
সমাজতত্ত্ববিদদের অনেকেই মনে করছেন, প্রাচীকে যে ভাবে ট্রোল করা হয়েছে, তা আসলে ওতোপ্রতো ভাবে যুক্ত বডি শেমিং, টক্সিক বিউটি স্ট্যান্ডার্ড ও নারীদের পণ্যায়িত করার দিকেই ইঙ্গিত করছে। তার মেধা, বৌদ্ধিক উৎকর্ষ, অ্যাকাডেমিক সাকসেস-কে সেলিব্রেট না করে এক শ্রেণির মানুষ পিছনের দিকে হেঁটে তাঁদের পশ্চাদ্গামী ও নেতিবাচক মানসিকতার প্রমাণ দিচ্ছেন।
এই ধরনের ট্রেন্ড অত্যন্ত আশঙ্কার। সমাজবিদ্যার এক শিক্ষিকার কথায়, 'এই মুহূর্তে এই ধরনের মানসিকতাকে চ্যালেঞ্জ করা প্রয়োজন। আমাদের চেষ্টা করতে হবে ক্ষতিকারক ন্যারেটিভের বদলে যাতে প্রত্যেককে যে যেমন, তাঁকে সে ভাবেই গ্রহণ করা ও স্বীকৃতি দেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে তোলার।'
এ প্রসঙ্গে তিনি উদাহরণ দিলেন কেরালার এক মহিলার। তাঁর নাম শাইজা। তিনি পিতৃতান্ত্রিক সৌন্দর্যের মাপকাঠিকে তোয়াক্কা না করে নিজের ফেশিয়াল হেয়ার রেখে দিয়েছিলেন। গোঁফ নিয়ে তাঁর যে ছবি ভাইরাল হয়েছিল তা 'সেল্ফ অ্যাকসেপটেন্স'-এর বার্তাই দেয়। প্রাচীও যে সেই নর্মকে একদিন আরও দৃঢ় ভাবে চ্যালেঞ্জ করবে সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত।