এই সময়: দুর্নীতি ঠেকানোর জন্য যে সংস্থার জন্ম, তার বিরুদ্ধেই এখন অনিয়মের সবথেকে বড় অভিযোগ। ১৯৯৭ সালে স্কুল সার্ভিস কমিশন বা এসএসসি পথচলা শুরু করে এবং ১৯৯৯-এ প্রথম এসএসসির মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগ শুরু হয়। তার আগে এই শিক্ষক নিয়োগ নিয়েই দুর্নীতির একের পর এক অভিযোগ উঠছিল। তখন নিয়োগ ছিল পুরোপুরি স্কুল পরিচালন সমিতির হাতে। সেই দুর্নীতি বন্ধ করতেই স্বশাসিত সংস্থা হিসেবে পথচলা শুরু করে এসএসসি।কিন্তু এখন সেই এসএসসি-ই বিদ্ধ অনিয়মের অভিযোগে। আদালতের রায়ে একলপ্তে চাকরি গিয়েছে ২৬ হাজার শিক্ষকের। বাছাই করা হয়নি যোগ্য এবং অযোগ্য শিক্ষকের মধ্যেও। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, গোলমাল ঠিক কোথায়? এসএসসির গঠনতন্ত্রেই? এ-ও প্রশ্ন, আগের ব্যবস্থাই তুলনায় ভালো ছিল? কারণ সেখানে দুর্নীতির অভিযোগে যদি কারও চাকরি গেলে প্রভাব পড়ত একটিমাত্র স্কুলেই। সার্বিক ভাবে এত হাজার হাজার শিক্ষকের চাকরি যেত না।
তবে অর্থনীতিবিদদের একাংশের আবার বক্তব্য, কেন্দ্রীয় ভাবে অনিয়ম হলে তার আন্দাজ পাওয়া সহজ। কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অনিয়ম হলে, তা ট্র্যাক
করা প্রায় দুঃসাধ্যই। সেটা আরও বড় অনিয়ম ছাড়া কিছু নয়। শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যের নির্যাস একটিই— দুর্নীতি না-করার সরকারি সদিচ্ছা থাকলে একাল-সেকাল, কখনওই অনিয়ম হয় না।
১৯৯৭ সালে এসএসসি তৈরির আগে কী ভাবে শিক্ষক নিয়োগ হতো? কোনও স্কুলে শিক্ষকের শূন্যপদ থাকলে তা প্রথমে জেলা স্কুল পরিদর্শক বা ডিআইকে জানাতে হতো। ডিআই অনুমতি দিলে সংরক্ষণের নিয়ম ও রস্টার মেনে নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো অথবা এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জকে তা জানাতে হতো। ইন্টারভিউ বোর্ড গঠন করত স্কুলের পরিচালন সমিতি।
সেখানে প্রধান শিক্ষক, পরিচালন সমিতির সভাপতি, শিক্ষক বিশেষজ্ঞ এবং গ্রামের স্কুল হলে পঞ্চায়েত সমিতির কোনও এক সদস্য, শহরের স্কুল হলে রাখা হতো কোনও শিক্ষাবিদকে। চাকরিপ্রার্থীদের ইন্টারভিউ ও ডেমো ক্লাস দিতে হতো। এর ভিত্তিতেই তৈরি হতো প্যানেল, যেখানে সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্তকে চাকরিতে যোগ দেওয়ার অ্যাপ্রুভাল দিতেন ডিআই।
কিন্তু দেখা যাচ্ছিল, এই পদ্ধতিতে প্রধান শিক্ষক এবএক্নিপইন্টারভিউ বোর্ডের প্রভাবশালীদের ঘুষ অথবা স্কুলের ফান্ডে ডোনেশন দিয়ে অনেকে চাকরি পাচ্ছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে। রাজনৈতিক আনুগত্য ও স্বজনপোষণের অভিযোগও উঠতে শুরু করে। ১৯৯১ সালে বাম সরকারের আমলে অশোক মিত্র কমিশন এসএসসি তৈরির সুপারিশ করে বলে জানাচ্ছেন ওই কমিশনের সদস্য তথা শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার।
তাঁর বক্তব্য, ‘অনেক সময়ে দেখা যাচ্ছিল, স্কুল পরিচালন সমিতির সভাপতির মৌখিক সুপারিশেও চাকরি হয়ে যাচ্ছিল। সে কারণেই স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে এসএসসি তৈরির সুপারিশ করা হয়েছিল।’
পশ্চিমবঙ্গ প্রধান শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কৃষ্ণাংশু মিশ্রর কথায়, ‘আগে অনিয়ম হচ্ছিল স্থানীয় ভাবে। এখন কেন্দ্রীয় ভাবে। রাজ্যে যখন যে শাসকদল ছড়ি ঘুরিয়েছে, এসএসসিকে তারা এ ভাবেই ব্যবহার করেছে।’ বাম আমলে ২০০৪ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এসএসসির চেয়ারপার্সন ছিলে রণজিৎ বসু। তিনি অবশ্য এই অভিযোগ মানতে নারাজ— ‘যে আইনে এসএসসি চলে, সেটা স্বয়ংসম্পূর্ণ। কমিশন না চাইলে সরকারের এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার কোনও রাস্তা নেই।’ এ
ব্যাপারে অবশ্য কোনও মন্তব্যই করতে চাননি তৃণমূলের মাধ্যমিক শিক্ষক সংগঠনের রাজ্য সভাপতি সুব্রত গুহ। যাদবপুর বিদ্যাপীঠের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক পরিমল ভট্টাচার্যের সংযোজন, ‘বড় স্কেলে কোনও নিয়োগ হলে কোনও ব্যবস্থাই যেমন ফুলপ্রুফ নয়, এসএসসি-ও নয়। আইন মেনে কাজ করলে এই সমস্যা আর থাকে না।’
কী ভাবে এই ব্যবস্থাকে দুর্নীতি-মুক্ত করা যায়? পবিত্রর বক্তব্য, ‘নিয়োগের ক্ষেত্রে আদালতের প্রতিনিধিকে ভিজিল্যান্স করার দায়িত্ব দেওয়া যায়।’
আর বেথুন স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষিকা শাশ্বতী অধিকারী মনে করেন, পরীক্ষা থেকে শুরু করে ইন্টারভিউ পুরোটাই ডিজিটাইজ় করা খুব জরুরি। ডিজিটাল রেকর্ড থাকলে এই সমস্যা দূর করা অনেক সহজ হবে বলে মনে করেন তিনি।