সে মহৎ কিছু করছে না, তার দারিদ্র যাচ্ছে না, তার অভাব মিটছে না, কিন্তু তা সত্ত্বেও সে জীবনবিমুখ হচ্ছে না, সে পালাচ্ছে না, এস্কেপ করছে না, সে বাঁচতে চাইছে, সে বলছে বাঁচার মধ্যেই স্বার্থকতা, তার মধ্যেই আনন্দ, হি ওয়ান্টস টু লিভ... ‘অপুর সংসার’-এ বন্ধু পুলুকে একনাগাড়ে এই কথাগুলো বলেছিল অপু, অপূর্বকুমার রায়।কলেজ পাশ করা অপুর তখনও সংসার শুরু হয়নি। তখনও সে পিছুটানহীন। শান্তিপুরের রাহুল চক্রবর্তী কিন্তু সেই ক্লাস নাইন থেকেই সংসারের হাল ধরতে শিখে গিয়েছেন। এতে তাঁর আক্ষেপ নেই। কারণ, হি ওয়ান্টস টু লিভ। রাহুলের বেঁচে থাকার গান শোনা যায় লোকাল ট্রেনে। বাদামের খাজা, তিলের খাজা বলে হাঁক পেড়ে হকারি করেন তিনি।
এইচএস পাস রাহুলের জীবন-জীবিকার সেই ভিডিয়ো এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে। অনেকেই দাঁড়িয়েছেন তাঁর পাশে। তবে ভাইরাল-স্রোতে ভেসে যেতে চান না রাহুল। নিজেই বললেন, ‘আবার পড়াশোনা শুরু করছি। তবে যে হকারি ভাত দিচ্ছে, সেটা ছাড়তে চাই না।’
বাবা প্রয়াত, মা থেকেও অচেনা, দাদা পাকাপাকি ভাবে পিসির বাড়িতে— এমন সংসারে রাহুলের পিছুটান বলতে রয়েছেন কেবল ৮৩ বছরের ঠাকুরদা। কিডনির রোগ, কোমরের ভাঙা হাড় ও নানাবিধ বয়সজনিত কারণে বাড়ির ছোট মুদির দোকানটাও চালাতে পারছিলেন না ঠাকুরদা সন্তোষ চক্রবর্তী। তবে কোনও ভাবে টেনেটুনে নাতির পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন। শান্তিপুর হিন্দু উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০২২ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছেন শান্তিপুর পাওয়ার হাউস এলাকার বাসিন্দা রাহুল।
কিন্তু ছোট সংসারের বড় দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে পড়াশোনা ছাড়তে হয়েছে তাঁকে। কলেজে ভর্তি হতে পারেননি। হাতে তখন অ্যাডমিশন ফি-র টাকাও ছিল না। তবে অপুর সেই গল্পের চরিত্রের মতো রাহুলও জীবনবিমুখ হননি। কলেজে ভর্তি হতে না-পেরে চলে গিয়েছিলেন বেঙ্গালুরু রান্নার কাজ নিয়ে। কিন্তু ফিরে আসতে হয় এক দুর্ঘটনায় ঠাকুরদার কোমরের হাড় ভাঙলে।
তার পর থেকে ঠাকুরদার মাসকাবারি ওষুধের টাকা ও দু’বেলার ভাতখরচ জোগাতে রাহুল লোকাল ট্রেনে হকারি শুরু করেন। মাস ছয়েক ধরে এ ভাবেই চলছে রাহুলের সংসার। গত ৭ এপ্রিল ট্রেনে রানাঘাটে বাড়ি ফিরছিলেন সমাজকর্মী অতীন্দ্র চক্রবর্তী। শান্তিপুর স্টেশনে ট্রেনের বগিতে তখন হাতে বাদামের আর তিলের খাজা, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ নিয়ে হকারি করছেন বছর কুড়ির ঝকঝকে তরুণ। সঙ্গে মুখে একগাল হাসি। আলাপ হয় রাহুলের সঙ্গে।
তাঁর চোখমুখ, লম্বা সুঠাম চেহারা দেখে অতীন্দ্রর খটকা লাগে। চেনা হকারদের মতো একেবারেই নয়। ‘পড়াশোনা করো মনে হচ্ছে?’ অতীন্দ্রর প্রশ্নে রাহুল বলেন, ‘করতাম। এখন করি না।’ রাহুলের কাছ থেকে অতীন্দ্র জানতে পারেন, তাঁর বাবার মৃত্যুর মাসখানেক পরেই রাহুল ও তাঁর থেকে তিন বছরের বড় দাদাকে ছেড়ে চলে যান মা। রাহুলের বয়স তখন ৫-৬ বছর হবে। তাঁর মা একই পাড়ায় দ্বিতীয় বিয়ে করেন।
তার পর আর ছেলেদের খোঁজ নেননি। তখন ঘরে চরম অর্থাভাব। বাবাকে বাঁচাতে ঠাকুরদা শেষ সম্বলটুকুও বিক্রি করে দিয়েছিলেন। কয়েকদিন পরে পলাশি থেকে পিসিরা এসে দাদা সৌরভকে নিয়ে যান। সেই থেকে ঠাকুরদার কাছেই বড় হয়েছেন রাহুল। রাহুলের সঙ্গে কথোপকথনের ভিডিয়ো অতীন্দ্র দিয়েছিলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। তিনি বলেন, ‘রাহুলের জীবনযুদ্ধ ছুঁয়ে গিয়েছে বহু মানুষকে। অনেকেই ওঁর পাশে দাঁড়াতে চেয়েছেন।’
গত কয়েকদিন ধরে অচেনা মানুষজনের ভালাবাসা পেয়ে আপ্লুত রাহুলের কথায়, ‘অনেকে আর্থিক ভাবে সাহায্য করছেন। কাজকর্মের খোঁজও দিচ্ছেন। সুদূর ইংল্যান্ড থেকেও একজন যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু সবাই তো আর সবসময় পাশে থাকবে না। হয়তো এক-দু’জন থেকে যাবেন। কিন্তু নিজের লড়াই তো নিজেকেই লড়তে হবে।’
আপাতত প্রতি রবিবার কলকাতায় গিয়ে ফিজ়িয়োথেরাপির ট্রেনিং নেওয়া শুরু করেছেন রাহুল। এবারের উচ্চ মাধ্যমিকের রেজ়াল্ট বেরোলেই শান্তিপুর কলেজে ভর্তি হবেন আর্টস নিয়ে। তবে ট্রেনে হকারি এখনই ছাড়তে চাইছেন না তিনি। কেন? রাহুলের উত্তর, ‘ক্লাস নাইন থেকে কখনও শান্তিপুরে কাপড়ের হাট, শাড়ির দোকান, ছোট হোটেল-রেস্তোরাঁয় রান্নার কাজ করে নিজের হাতখরচ নিজেই চালিয়ে এসেছি। এখনও পড়াশোনার পাশাপাশি হকারি করতে চাই। কারণ, এর থেকে আমি যা রোজগার করব তা আমার নিজের।’
সোশ্যাল মিডিয়ায় অতীন্দ্রর পোস্টে অনেকেই কমেন্ট করে জানতে চেয়েছেন, এত কষ্টের পরেও রাহুল এমন হাসি-মুখে থাকে কীভাবে? সহজ কথায় তাঁর উত্তর, ‘যতই কষ্ট হোক, মুখে হাসি থাকলে একটু হলেও ভালো থাকা যায়।’