এই সময়: কলকাতা হাইকোর্টের রায় ঘোষণার পরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বার্তা দিয়েছিলেন, তিনি সব চাকরিহারার পাশে থাকবেন। মঙ্গলবার তিনি এ প্রশ্নও তুলেছেন, যদি এই চাকরিহারাদের কেউ আত্মহত্যা করেন, তাহলে তার দায় কে নেবে? আদালতের রায়ে যে 'যোগ্য' প্রার্থীদেরও চাকরি গিয়েছে, মঙ্গলবার তাঁরা কলকাতায় শহিদ মিনারের সামনে অবস্থানমঞ্চ থেকে জানিয়েছিলেন, এসএসসি ও রাজ্য সরকারের মতো তাঁরাও সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হবেন।ইতিমধ্যে জেলায় জেলায় এই চাকরিহারাদের অনেকে প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন, অনেকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে গভীর আশঙ্কার মধ্যে রয়েছেন। বুধবারও এই চাকরিহারারা ধর্মতলায় শহিদ মিনার চত্বরে অবস্থানে বসেন। তাঁদের অনেকে আবার এসএসসি-র অফিসের সামনে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন।
যোগ্য-অযোগ্য নির্বিশেষে একলপ্তে হাজার হাজার ছেলেমেয়ের চাকরি হাইকোর্টের নির্দেশে বাতিল হওয়ার পরে বিরোধী শিবিরও বুঝতে পারছে, ভোটের বাকি দফাগুলিতে এর বিরূপ প্রভাবে তাদেরও ভুগতে হতে পারে। সম্ভবত সে কথা বুঝেই এদিন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার এবং সিপিএমের শিক্ষক সংগঠন এবিটিএ-র তরফে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, 'যোগ্য' চাকরিপ্রার্থীদের পাশে রয়েছেন তাঁরা। আইনি লড়াইয়ে সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়েছে দু'পক্ষ।
এসএসসি-র শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের চাকরি বাতিলের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে বুধবারই সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছে এসএসসি, মধ্যশিক্ষা পর্ষদ ও রাজ্য সরকার। মমতা মনে করছেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালতে চাকরিহারা ছেলেমেয়েরা 'সুবিচার' পাবেন। রাজ্য সরকার স্কুলের শূন্যপদে নিয়োগ করতে উদ্যোগী হলেও বিজেপি-সহ বিরোধী শিবির বারবার আদালতে গিয়ে সেই নিয়োগে বাধা সৃষ্টি করছে বলে তৃণমূল নেতৃত্বের অভিযোগ।
তাই চলতি লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি তথা বিরোধীপক্ষকে একটিও ভোট না দেওয়ার জন্য রাজ্যের সমস্ত শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীদের কাছে আর্জি জানিয়েছেন তৃণমূলনেত্রী। এদিন পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামে নির্বাচনী সভায় মমতা বলেন, 'শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বলব, ২৬ হাজার ছেলেমেয়ের চাকরি খেয়ে নেওয়ার প্রতিবাদে কোনও শিক্ষক-শিক্ষিকা, সরকারি কর্মচারী একটি ভোটও বিজেপিকে দেবেন না। সিপিএম, কংগ্রেসকেও দেবেন না। এরা চাকরি খেয়ে নিচ্ছে। আপনার ভবিষ্যৎ খেয়ে নিচ্ছে। কে জানে, কাল আবার চাকরি খাবে কি না! এরা যত তাড়াতাড়ি বিদায় নেয় ততই দেশের মঙ্গল।'
আগামী দিনেও রাজ্য সরকার নিয়োগ করতে গেলে তা মামলার গেরোয় আটকে যাবে কি না, তা নিয়েও প্রবল সংশয়ী মমতা। তাঁর কথায়, 'আমার হাতে সরকারি দপ্তরে ১০ লক্ষ একস্ট্রা চাকরি রয়েছে। এরা কোর্টে গিয়ে সব আটকে দিচ্ছে। বিজেপি-র এটা মহাতীর্থ কেন্দ্র! সেখানে বিজেপি পিআইএল করলেই যা বলবে, তাই-ই হবে। অন্য কেউ যদি বিচার চায়, তাদের জন্য দরজা বন্ধ। বিজেপির কথায় মানুষের চাকরি খেয়ে নিচ্ছে আর ডাকাতদের, মাফিয়াদের বেল দিচ্ছে।'
মমতা চাকরিহারাদের পাশে থাকার স্পষ্ট বার্তা দেওয়ার পরে এদিন 'যোগ্য'দের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলেছে বিজেপি ও সিপিএম। সুকান্ত এদিন বলেন, 'তৃণমূলের লোকেদের টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েছে এই সংখ্যাটা প্রায় পাঁচ হাজার। ব্রাত্য বসুরা কি পারতেন না এই পাঁচ হাজারের নাম আলাদা করে আদালতে দিতে? তা হলে তো যোগ্যদের চাকরি বাতিল হতো না। যাঁরা যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও এখন কষ্টের মধ্যে রয়েছেন, তাঁদের প্রয়োজনে আমরা আইনি সহায়তা দেবো।'
রাজ্য সরকারকে দুষে 'যোগ্য'দের পাশে দাঁড়াতে সুপ্রিম কোর্টের পথে হাঁটছে নিখিলবঙ্গ শিক্ষক সমিতিও (এবিটিএ)। সিপিএমের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের এই শিক্ষক সংগঠনের বক্তব্য, দুর্নীতির বিরুদ্ধে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছে, তাতে অনেক 'যোগ্য' শিক্ষকও চাকরি হারিয়েছেন।
এবিটিএ-র সাধারণ সম্পাদক সুকুমার পাইনের কথায়, 'রাজ্য সরকার যদি এ বিষয়ে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ করত, তা হলে এই পরিস্থিতি তৈরিই হতো না। সরকার অযোগ্যদের আড়াল করতে চেয়েছে। তাতে ভুক্তভোগী হচ্ছেন যোগ্য শিক্ষকেরাও। আমরা যোগ্য শিক্ষকদের পাশে দাঁড়াচ্ছি। নিজেদের খরচেই আমরা এই মামলা লড়ব।' সিপিএম নেতা সূর্যকান্ত মিশ্রর কথায়, 'এই মানবিক উদ্যোগের জন্য এবিটিএ-কে অভিনন্দন জানাই।'
এদিন শহিদ মিনার চত্বরে যে 'যোগ্য' চাকরিহারারা আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন, তাঁদের প্রশ্ন, অযোগ্যদের অনিয়মের দায় তাঁদের ঘাড়ে কেন এসে পড়বে? চাকরিহারা এক শিক্ষক বলেন, 'আমরা এখন দলে দলে গিয়ে গায়ে কেরোসিন তেল ঢেলে কমিশনের সামনে সুইসাইড করব। এ ছাড়া আর কী পথ খোলা? এসএসসি-ই বলছে, সিবিআই তদন্তে উঠে এসেছে, পাঁচ হাজার জন চুরি করেছে। তার খাঁড়া আমাদের উপর এসে পড়ল, আমরা জানতেও পারলাম না।'
আর এক চাকরিহারা শিক্ষকের কথায়, 'আজকে খাচ্ছি, কালকে কীভাবে খাব, সেটাই ভাবাচ্ছে। খাই না খাই, লোনের টাকা তো দিতেই হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ পুরোটাই অনিশ্চিত।' তৃণমূলনেত্রী অবশ্য মনে করছেন, সুপ্রিম কোর্টে এঁরা সঠিক বিচার পাবেন। মমতার কথায়, 'এরা (বিজেপি) হাইকোর্ট কিনে নিয়েছে। আমি সুপ্রিম কোর্টের কথা বলছি না। সুপ্রিম কোর্টর কাছে আমরা এখনও বিচারের আশায় আছি। এরা সিবিআই কিনে নিয়েছে, এনআইএ, বিএসএফ কিনে নিয়েছে।'
আউশগ্রামের সভায় মমতা আরও বলেন, 'শুনুন, আমিও আইনের ছাত্র ছিলাম। বার কাউন্সিলে এখনও মেম্বার আছি। আমি যে কোনওদিন কোর্টে লইয়ার হিসাবে নামতে পারি। জাজদের নিয়ে কথা বলব না। কিন্তু জাজমেন্ট নিয়ে কথা বলার অধিকার রয়েছে। আমি (এই রায়) মানি না।' তাঁর সংযোজন, 'যদি অন্যায় কেউ করে থাকে, তুমি স্ক্রটিনি করতে পরামর্শ দিতে পারতে। তা না-করে এক কথায় ২৬ হাজার ছেলেমেয়ের চাকরি খেলেন। এটা কি মজার মুলুক?'
একসঙ্গে এত ছেলেমেয়ের চাকরি চলে যাওয়ার পিছনে বিজেপি-বাম সমেত সমগ্র বিরোধীপক্ষকে কাঠগড়ায় তুলেছেন মমতা। তাঁর কথায়, 'চাকরি দেওয়ার ক্ষমতা নেই, চাকরি কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতায়ন হয়েছে! ভাত দেওয়ার ক্ষমতা নেই, কিল মারার গোঁসাই! আমাদের সরকার যখন চাকরি দেয়, কী ভাবে ডিপার্টমেন্ট চাকরি দেয়-সেটা সেই ডিপার্টমেন্টের ব্যাপার। আমি ইন্টারফেয়ার করি না। কিন্তু এই ২৬ হাজার ছেলেমেয়ে যাবে কোথায়? বাংলায় কি সব স্কুল বন্ধ হয়ে যাবে?'