ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা, ইউরোপে খারিজ ৫২৭ ভারতীয় খাদ্যদ্রব্য
এই সময় | ২৬ এপ্রিল ২০২৪
এই সময়: অজান্তে কতটা বিষ যে রোজ আমাদের পেটে ঢুকছে, কে জানে! আমাদেরই দেশের তৈরি পাঁচ শতাধিক খাদ্যদ্রব্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন আটকে দেওয়ার ঘটনাই এই সন্দেহ উসকে দিলো। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের র্যাপিড অ্যালার্ট সিস্টেম ফর ফুড অ্যান্ড ফিড-এর রিপোর্ট থেকে বুধবার জানা গিয়েছে, গত প্রায় চার বছরে ভারত থেকে রপ্তানি করা ৫২৭ ধরনের খাদ্যদ্রব্যে মিলেছে ইথিলিন অক্সাইড নামে এমন একটি জৈব রাসায়নিক যা আদতে কার্সিনোজেনিক।অর্থাৎ, ক্যান্সারের জন্ম দিতে সক্ষম। চিকিৎসকরা চিন্তিত, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কড়াকড়িতে এই সব খাদ্যপণ্যগুলি আটকে গেলেও এ দেশে তো সেগুলি দেদার বিকোচ্ছে এবং আম ভারতবাসীর পেটেও ঢুকে চলেছে লাগাতার!
কোন কোন খাদ্যদ্রব্যে ধরা পড়েছে ইথিলিন অক্সাইড? মূলত প্যাকেটের বাদাম, তিল, ভেষজ পদার্থ, মশলা, ডায়েটিক ফুড এবং অন্যান্য খাদ্যপণ্যে মিলেছে কার্সিনোজেনিক ওই যৌগের অস্তিত্ব। ৫২৭ ধরনের খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে আবার ৫৪টি খাদ্যপণ্যের প্যাকেটে ‘জৈব’ বলে লেবেলও সাঁটা ছিল। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, তাতে ভুল কিছু নেই।
কেননা, ইথিলিন অক্সাইড এক ধরনের ইথার, অর্থাৎ জৈব পদার্থই। ব্ল্যাকলিস্টেড খাদ্যদ্রব্যগুলির মধ্যে ছিল ৩১৩ রকমের বাদাম ও তিল, ৬০ রকমের ভেষজ পদার্থ ও মশলা, ৪৮ রকমের ডায়েটিক ফুড এবং ৩৪ রকমের অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য।
বিশেষজ্ঞরা চিন্তিত, গোলমরিচের মতো সাধারণ মশলা কিংবা অশ্বগন্ধার মতো ভেষজ পদার্থেও মিলেছে ইথিলিন অক্সাইড। ২০২০-র সেপ্টেম্বর থেকে চলতি এপ্রিল মাস পর্যন্ত এই সব খাদ্যপণ্যের মোট ৮৭টি কনসাইনমেন্ট তাই বাতিল করে দিয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। সূত্রের দাবি, ১৯৯১ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ইথিলিন অক্সাইডকে ‘জেনোটক্সিক কার্সিনোজেন’ (জিনগত পরিবর্তন করে ও ক্যান্সারের জন্ম দেয়) বলে নিষিদ্ধ করার পর এত খাদ্যপণ্য বা এত কনসাইনমেন্ট গুণগত কারণে বাতিল হয়ে যাওয়ার নজির অতীতে আর নেই।
র্যাপিড অ্যালার্ট সিস্টেমের দাবি, এই যৌগের কোনও সহনসীমা হয় না মানব শরীরে। অর্থাৎ, এই যৌগের অস্তিত্ব যত কমই হোক, তা চরম ক্ষতিকারক। এখানেই বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলছেন, আমরা তা হলে কতটা সুরক্ষিত? কেননা, খাদ্য সররক্ষণের জন্য প্রিজার্ভেটিভ হিসেবে ইথিলিন অক্সাইডের ব্যবহার তো এ দেশে বিনা বাধাতেই হয়। অথচ বাতাসে ভাসমান অবস্থায় থাকা ইথিলিন অক্সাইডের সহনসীমা মানব শরীরে আট ঘণ্টায় ৫ পার্টস-পার-মিলিয়ন হলেও খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে কোনও সহনসীমার কথা উল্লেখ নেই বিজ্ঞানে।
ক্যান্সার শল্য-চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘খাদ্যদ্রব্যে কিন্তু ইথিলিন অক্সাইড ছিটেফোঁটা থাকারও কথা নয়। অথচ আশ্চর্য, ইউরোপে নিষিদ্ধ একটি কার্সিনোজেন এখানে বিনা বাধায় চলছে! এবং ওই সব পণ্যের লেবেলিংয়েও তার উল্লেখ থাকে না! জানি না, আমাদের স্বাস্থ্যের কী হাল হচ্ছে!’
একই সুর ডায়েটিশিয়ান অরিজিৎ দে-র গলায়। তাঁর বক্তব্য, ‘ইথিলিন অক্সাইডের অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল চরিত্র রয়েছে। সে জন্য সস্তার প্রিজার্ভেটিভ হিসেবে এটি অনেকেই ব্যবহার করে। বস্তুত অনেক বড় ব্র্যান্ডও ব্যবহার করে যৌগটি। আমাদের খাদ্যসুরক্ষা বিধি ইউরোপের মতো কড়া নয় বলেই এমনটা চলছে।’
মেডিক্যাল অঙ্কোলজিস্ট দেবপ্রিয় মণ্ডল জানান, ইথিলিন অক্সাইড খাবারের মধ্যে দিয়ে লাগাতার শরীরে ঢুকলে তার জেরে লিম্ফোমা ও লিউকেমিয়ার মতো রক্তের ক্যান্সারের পাশাপাশি স্তন ও পাকস্থলির ক্যান্সারের আশঙ্কাও বাড়ে। দেবপ্রিয়র কথায়, ‘কে জানে, আমাদের দেশে যে এই সব ক্যান্সার হু-হু করে বাড়ছে, তার নেপথ্যে ইথিলিন অক্সাইড নেই! অনেক ক্যান্সারের ক্ষেত্রেই তো তামাকাসক্তির মতো নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।’
আর এক অঙ্কোসার্জেন শ্রীনিকেত রাঘবন মনে করেন, ইথিলিন অক্সাইডের কারণে ইউরোপ এত খাদ্যদ্রব্য খারিজ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি শুধু চিন্তারই নয়, যথেষ্ট লজ্জারও। তিনি বলেন, ‘ক্যান্সারের পাশাপাশি যৌগটি স্নায়বিক নানা সমস্যার পাশাপাশি বন্ধত্যেরও জন্ম দিতে পারে।’