• তাপ-খরার প্রবেশেই ইন্ডিয়ায় ইনভেশন
    এই সময় | ২৭ এপ্রিল ২০২৪
  • ইতিহাস বদলের নেপথ্যে কি হাত ভূগোলের? জার্নাল অফ আর্থ সিস্টেম সায়েন্সে চার গবেষকের প্রকাশিত প্রবন্ধের ইঙ্গিত যেন সেই দিকেই। গত কয়েক হাজার বছরে যে বহুবার ভারতে বিদেশি অনুপ্রবেশ ঘটেছে এ বিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই ঐতিহাসিকদের। তবে পারস্যের সম্রাট দ্বিতীয় সাইরাস থেকে শুরু করে সম্রাট আলেকজ়ান্ডার এবং আরও পরে মহম্মদ বিন কাশেম থেকে শুরু করে মহম্মদ ঘোরি- প্রত্যেক অনুপ্রবেশের মধ্যেই এমন একটা প্যাটার্ন খুঁজে পেয়েছেন এই গবেষকরা, যেটা আগে নজরে আসেনি অনেকেরই। ভারতের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ওই প্যাটার্ন যত না ঐতিহাসিক,তার চেয়েও অনেক বেশি ভৌগোলিক বলে মনে করেছেন গবেষকরা।গবেষণার বিষয় ইতিহাস হলেও তার ভিত্তি ভূগোল। আরও স্পষ্ট ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় আবহবিদ্যা। পুনের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ট্রপিক্যাল মিটিওরোলজির (আইআইটিএম) গবেষক স্মৃতি সর্দার, পার্থসারথি মুখোপাধ্যায় এবং নবীন গান্ধী ও রাঁচির বিড়লা ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির ডিপার্টমেন্ট অফ রিমোট সেন্সিংয়ের প্রত্যুষা মুখোপাধ্যায় মিলিত ভাবে ওই গবেষণাপত্রটি লিখেছেন। এখানেই দেখানো হয়েছে ৬০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে শুরু করে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ - ভারতের ২২০০ বছরের ইতিহাসে যতগুলো মোড় ঘোরানো অনুপ্রবেশ হয়েছে তার প্রায় সব ক'টার মূলেই রয়েছে আবহাওয়ার পরিবর্তন।

    কেন এত ঘন ঘন অনুপ্রবেশ ভারতে? কীসের টানে কখনও পারস্য বা আজকের ইরান, কখনও আফগানিস্তান আবার কখনও আরও উত্তরে আজকের তুর্কমেনিস্তান বা উজবেকিস্তানের মতো কোনও জায়গা থেকে ভারতের দিকে ছুটে এসেছে শক, হুন, পাঠান, মোগলের দল? শুধুই কি ভারতের ঐশ্বর্যের টানে? পুরোনো এই ধারণাকে আর ধ্রুব সত্য বলে মানতে রাজি নন গবেষকরা। তাঁদের মতে শুধুই লোভে নয়, নিছক খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার প্রাথমিক শর্তটুকু পূর্ণ করতেই সিংহভাগ অনুপ্রবেশ হয়েছিল।

    গবেষণার অন্যতম লেখক আইআইটিএম-এর আবহবিদ পার্থসারথি মুখোপাধ্যায় বলছেন, 'আমরা ২২০০ বছরে মোট ১১টা বড় ধরনের অনুপ্রবেশের সময় বেছে নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। পারস্যের সম্রাট দ্বিতীয় সাইরাসের সময় থেকে শুরু করে মহম্মদ ঘোরির অনুপ্রবেশ এবং তার পরে আরও কয়েকশো বছর আমাদের গবেষণায় জায়গা পেয়েছে।' আইআইটিএম-এর গবেষক নবীন গান্ধী এ দেশের হাতেগোনা কয়েকজন প্যালিও-ক্লাইমেটোলজিস্টদের অন্যতম। এঁদের গবেষণার বিষয় হলো অতীত পৃথিবীর আবহাওয়া। এই গবেষণাপত্র সম্পর্কে নবীন গান্ধী বলছেন, 'অতীতে একটা নির্দিষ্ট এলাকায় এবং নির্দিষ্ট সময়ে আবহাওয়া কেমন ছিল সেই সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করে দেখেছি যখন যখন মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকার জলবায়ু টানা কয়েক বছর ধরে খারাপ থেকেছে, সেই সময়েই ওই অঞ্চল থেকে ভারতে অনুপ্রবেশের হার বেড়ে গিয়েছে।' উদাহরণ হিসেবে ওঁরা প্রথমে দেখিয়েছেন, ৬৫০-৪৯০ খ্রিস্টপূর্বের সময়টিকে। ওই সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশ টানা স্বাভাবিক বা তার চেয়ে বেশি বৃষ্টি পেয়েছিল। কিন্তু, পারস্যের দিকে ওই সময়ে খরা চলছিল। ইতিহাস বলছে ওই সময়ে ভারতের দিকে প্রথম এগিয়েছিল পারসিক সেনা। আবার আরব বাহিনীর ভারত অভিযানের সময়ে অর্থাৎ ৬৫০-৭১০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ভারতে জলবায়ু স্বাভাবিক থাকলেও মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ায় তখন খরা চলেছিল। ওই অভিযানেই মহম্মদ বিন কাশেমের হাতে সিন্ধুজয় হয়। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা যায় ১১২৫-১১৮০ সালেও। ওই সময়েই আফগানিস্তান থেকে পরপর ভারতে আক্রমণ শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত মহম্মদ ঘোরির কাছে পরাজিত হন পৃত্থীরাজ চৌহান।

    গবেষণায় দেখানো হয়েছে মধ্য এশিয়ার জলবায়ু এবং বৃষ্টিভাগ্য বদলাতে শুরু করে ৩০০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে। এর ফলে ওই অঞ্চলের ঘাসজমি ক্রমশ নষ্ট হতে শুরু করে। সবুজ ঘাস কমতে শুরু করার ফলে স্থানীয় শিকারির দল তাদের ঘোড়ার পাল রক্ষা করতে বিভিন্ন দিকে এগিয়ে পড়ে। কৃষিকাজও ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সম্ভবত সেই সময়েই একদল পূর্বে এগিয়ে ভারতের আবহাওয়ায় আকৃষ্ট হয়। অন্য দিকে মধ্য এশিয়ার জলবায়ু বদলে গেলেও পুরোপুরি রক্ষা পায় ভারত। এ দেশে বৃষ্টির পরিমাণে তেমন কোনও বড় রকমের হেরফের ঘটেনি। এই কারণেই বিদেশিদের কাছে 'বেঁচে থাকা' এবং 'ভালো থাকার' জন্য সুজলা-সুফলা এবং শস্য-শ্যামলা ভারত লোভনীয় হয়ে ওঠে। প্রকৃতির এই খামখেয়ালিপনা ওই সময়ের পর থেকে বারবার দেখেছে মধ্য এশিয়া। সেই কারণেই বেড়েছে অনুপ্রবেশের হারও।
  • Link to this news (এই সময়)