বংশগত রোগ এবং অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কারণেই শুধু নয়। মাইক্রো-প্লাস্টিকের জেরেও মহিলাদের মধ্যে পলি-সিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম (পিসিওএস) নামক রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। কলকাতায় হওয়া সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় তেমনই ইঙ্গিত মিলেছে। গবেষণাটি হয়েছে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে।দেশে এই মুহূর্তে পিসিওএস রোগের শিকার প্রায় ১৩ শতাংশ মহিলা। ঠিকঠাক পরীক্ষা হলে এই অনুপাত অনেক বেশি হবে বলে গবেষকদের ধারণা। বাইরে থেকে দেখে এই রোগ চিহ্নিত করা কঠিন বলেও মত তাঁদের। অনিয়মিত ঋতুচক্র, অপরিপক্ব ডিম্বাণু, টেস্টোস্টেরনের আধিক্য, ডায়াবিটিস ও মোটা হওয়ার প্রবণতা এই রোগের প্রধান লক্ষণ।
গবেষণাপত্রটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে একটি আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞানপত্রিকা ‘ন্যানো ইমপ্যাক্ট’ জার্নালে। দাবির সপক্ষে ল্যাবের গবেষকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন জেব্রাফিস নিয়ে। পরীক্ষার জন্য জেব্রাফিসকে বেছে নেওয়ার কারণ হলো, এটি আদতে মাছ হলেও জিনগত ও শারীরবৃত্তীয় ভাবে এই মাছের সঙ্গে মানুষের মিল প্রায় ৭০ শতাংশ।
তা ছাড়া অন্য প্রাণীর ডিম্বাণুর সংখ্যা অনেক কম। তাই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো বেশ কঠিন। সে দিক থেকে এই মাছের জুড়ি মেলা ভার। একসঙ্গে কয়েকশো ডিম্বাণু পাওয়ায় বেশি করে পরীক্ষা চালানো সম্ভব হয়েছে বলে জানাচ্ছেন গবেষকরা। মানুষের শরীরে যে হারে মাইক্রো-প্লাস্টিক কণা ঢোকে, সেই হারে ৩ মাস বয়সী জেব্রাফিসকে মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা মিশ্রিত জলে ২১ দিন রাখার পরে দেখা গিয়েছে যে তাদের মধ্যে পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম রোগ তৈরি হয়েছে।
ডিম্বাণু ও অত্যধিক টেস্টোস্টেরনের ক্ষরণ, ওজন বৃদ্ধি, ডিম্বাণুর অপরিণত অবস্থায় থেকে যাওয়া, ওভুলেসন না হওয়া, স্ত্রী হরমোন ইস্ট্রোজেনের ক্ষরণ কম হওয়া, গোনাডোট্রোপিন হরমোনের অনুপাত বদলে যাওয়া প্রমাণ করে যে মাছগুলি পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোমের শিকার। পরীক্ষায় আরও দেখা গিয়েছে, রোগাক্রান্ত মাছেদের ফাস্টিং ব্লাড গ্লুকোজ় স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ।
পিসিওএস-এ আক্রান্ত মাছগুলিকে আরও ৩ মাস রাখার পরে দেখা গিয়েছে, তাদের ডিম্বাশয়ে অতিরিক্ত কোলাজেন ও লিপিড জমা হয়েছে। কী ভাবে মাইক্রো-প্লাস্টিক কণা পিসিওএস-এর জন্ম দিচ্ছে? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে গবেষকরা জানতে পেরেছেন, মাইক্রো-প্লাস্টিক কণা ডিম্বাশয়তেও অনুপ্রবেশ ঘটানোর জেরে শরীরে তৈরি হচ্ছে অতিরিক্ত স্ট্রেস। যার ফলে ডিম্বাশয়ে জন্ম নিচ্ছে ‘জারণ কণা’ বা ‘রিয়্যাক্টিভ অক্সিজেন স্পিসিস’।
এই জারণ কণা যে কোনও শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় পরিবর্তনের স্বাভাবিকত্বে বাধা দেয়। এর প্রভাবেই ওভুলেসনের জন্য দায়ী জিনগুলির এক্সপ্রেশন লেভেলের পরিবর্তন ঘটে। এমনকী, যৌন হরমোন তৈরির জন্য দায়ী জিনগুলিরও কার্যকারিতার মাত্রা পরিবর্তিত হয়। তাই ডিম্বাণুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, ঋতুচক্র অনিয়মিত হয় এবং ডিম্বাণুর গুণগত মান হ্রাস পাওয়ায় প্রজনন ক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হয়।
পরীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য মানুষের উপরেও একই ভাবে খাটে বলে মনে করছেন গবেষকরা। প্রতিদিন মাইক্রো-প্লাস্টিক কণা মানুষের শরীরে ঢোকায় পিসিওএস রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এখনই সচেতন না হলে আগামী দিনে মাতৃত্বের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হবেন হয়তো অনেক মহিলাই— মনে করছেন প্রকল্পের মুখ্য গবেষক, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিদ্যার অধ্যাপক কৌশিক প্রামাণিক এবং রিসার্চ স্কলার মধুছন্দা অধিকারী।
কৌশিক বলেন, ‘প্লাস্টিকের ছোট কণা আমাদের শরীরে ঢোকে প্রধানত জলের সঙ্গে। এখন বাড়ি বাড়ি জল সরবরাহ হয় প্লাস্টিক নলের মাধ্যমে। ফলে সহজেই মাইক্রো-প্লাস্টিক কণা জলে মেশে।’ এ প্রসঙ্গে প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ বাসব মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘পরিবেশ দূষণ, বিশেষত প্লাস্টিকের কারণে মহিলাদের মধ্যে পিসিওএস রোগ বাড়ছে, এটা সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি গবেষণায় উঠে এসেছে। তবে, এটা নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া জরুরি।’
আর এক প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ দিয়া চৌধুরী মনে করেন, ‘শুধু প্লাস্টিকই একমাত্র কারণ নয়। পরিবারের কারও থাকলেও এই রোগের পরবর্তী প্রজন্মের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।’ এই রোগে আক্রান্ত হলে নিয়মিত ব্যায়াম, খাদ্যাভ্যাসে কার্বোহাইড্রেট ও তেলমশলা কমানো, সবজি ও ফল খাওয়া বাড়ানো, বেশি করে জলপানের পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।