সেই অতুলনীয় স্বাদও বিস্বাদ! বিরিয়ানির প্লেটে কি ‘সূর্যগ্রহণ’? খাতায়-কলমে একসঙ্গে ৩০০ জনের বসে খাওয়ার ব্যবস্থা। ভিড় বেশি হলে একটু চেপেচুপে আরও ২০-২৫ জনকে ধরাতে হয়। বিশেষ করে, দুপুরের কয়েক ঘণ্টা তো দম ফেলার সময় পান না রেস্তরাঁর কর্মীরা। রোজ গড়ে ৫০ থেকে ৬০ হাঁড়ি বিরিয়ানি জাস্ট উড়ে যায়। রবিবার হলে আরও ১০ হাঁড়ি এক্সট্রা।কিন্তু গত ১৫-২০ দিন ধরে বেলা বাড়লেও ভিড় তেমন নেই ব্যারাকপুরের বিখ্যাত ‘দাদা-বৌদি’র বিরিয়ানি-তে। কয়েক ঘণ্টা সময় পেলেই যে খাদ্যরসিকের দল ‘চল দাদা-বৌদি যাই’ বলে মোটর বাইকে অনায়াসে ৫০-৬০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়েও হাজির হতেন মাটন বিরিয়ানি খেতে, তাঁদের সবার কি একসঙ্গে ‘বিরিয়ানি
বৈরাগ্য’ জন্মাল? কেস-টা ঠিক হয়েছে কী?
সেই কবে ১৮৫৬ সালে লখনৌ থেকে কলকাতায় এসে নেমেছিলেন নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ। আর সঙ্গে করে এনেছিলেন দম-পোক্ত বিরিয়ানির রেসিপি। তার পর বাকিটা ইতিহাস। ১৬৮ বছর আগে বাঙালি সেই যে বিরিয়ানির প্রেমে পড়ল, সেই নেশা কাটেনি আজও। মাঝখানের সময়টায় বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার রসনা-পরিবেশে লখনৌ থেকে আসা ওই মোগলাই খাবার পুরোদস্তুর কলকাত্তাইয়া হয়ে গিয়েছে।
তথ্য বলছে, কলকাতায় প্রতিদিন গড়ে ৯ হাজার টন বিরিয়ানি বিক্রি হয়। ২০২৩-এর শেষে সারা বছর কলকাতা ও শহরতলিতে বিক্রি হওয়া বিরিয়ানির পরিমাণ শুনলে সব কিছুতে অতি নিস্পৃহ কেউও হয়তো চমকে উঠবেন। হিসেব বলছে, শুধু ২০২৩-এ ৪১ লক্ষ প্লেট মাটন বিরিয়ানি এবং ২৬ লক্ষ প্লেট চিকেন বিরিয়ানি খেয়েছেন কলকাতা ও সংলগ্ন অঞ্চলের ভোজনরসিকরা।
বাঙালির বিরিয়ানি প্রেম নিয়ে বাজারে রসিকতার অভাব নেই। যেমন, অনুরোধ করলে একটা কিডনিও দিয়ে দিতে হয়তো রাজি হবেন, কিন্তু বিরিয়ানির আলুর ভাগ চাইলে? নৈব নৈব চ। আবার, মাটনের সাইজ় বাড়িয়েছেন খুব ভালো করেছেন, কিন্তু সেই অজুহাতে ডিম বাতিল করা যাবে না— রেস্তরাঁ বা ইটারির মালিককে এমনও জানিয়ে দেন কোনও কোনও বিরিয়ানিপ্রেমী।
যাঁরা বিরিয়ানির নাম শুনলেই নালে-ঝোলে এমন বে-এক্তিয়ার হয়ে পড়েন, টানা তাপপ্রবাহে তাঁদের তীব্র বিরিয়ানি প্রেমেও এখন ভাটার টান। কতটা? তার হিসেব দিচ্ছেন শহর ও শহরতলির নামী বিরিয়ানি বিক্রেতারাই। ব্যারাকপুরের দাদা-বৌদির বিরিয়ানির তরফে সঞ্জীব সাউ বলছেন, ‘দুপুরের দিকে যাঁরা আসতেন, প্রবল রোদে তাঁদের সংখ্যা একেবারে তলানিতে।
আগে যেখানে বসার জায়গা পেতে অন্তত এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো, এখন সেই জায়গা ফাঁকা। আমাদের বিক্রি অন্তত ৩০ শতাংশ কমে গিয়েছে।’ দাদা-বৌদির হিসেবে, দিনে গড়ে ৬০ হাঁড়ি বিরিয়ানির জায়গায় এখন ৪৫ হাঁড়িতেই কাজ হয়ে যাচ্ছে। বিরিয়ানি অবশ্যই রিচ ফুড বা মশলাদার খাবারের গোত্রে পড়ে। তবে বিরিয়ানির মধ্যেও গরগরে ও হালকা— এই তফাত রয়েছে বিলক্ষণ।
খিদিরপুরের ‘ইন্ডিয়া রেস্তরাঁ’র বিরিয়ানিকে যেমন বহু ভোজনরসিকই গণ্য করেন হালকা হিসেবে। কিন্তু এই ভয়াবহ গরমে হালকা বিরিয়ানিও যে তেমন রুচছে না! ‘ইন্ডিয়া রেস্তরাঁ’র অন্যতম কর্ণধার সৈয়দ আনোয়ার আজ়িম জানাচ্ছেন, তাঁদের রেস্তরাঁয় বিরিয়ানির বিক্রি ১১ শতাংশ কমেছে।
‘হ্যাংলাথেরিয়াম’ চেনেরও বিরিয়ানি হালকা। তবে এই গরমে বিশেষ করে রেস্তরাঁয় বসে খাওয়ার প্রবণতা যে অনেকটাই কমেছে, সে কথা স্বীকার করে হ্যাংলাথেরিয়ামের অন্যতম কর্ণধার পিয়ালী বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘বিরিয়ানির বিক্রি মোটের উপর ১০-১৫ শতাংশ কমেছে। গরমের প্রভাব পড়েছে হোম ডেলিভারির উপরেও।’ কোনও ভাবে কি বিরিয়ানিতে ব্যবহার করা উপকরণগুলোর পরিমাণে কিছুটা এ দিক-ও দিক করে সেটা আরও হালকা ও গরমে খাওয়ার উপযুক্ত করা সম্ভব?
‘একেবারেই না। সেটা করতে গেলে স্বাদ বদলে গিয়ে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। তার চেয়ে গরম কমার অপেক্ষা করা ভালো’— সাফ বলছেন পিয়ালী। একবার বৃষ্টি নামলেই ফের তুঙ্গে উঠবে বিরিয়ানির বিক্রি, মনে করছেন ‘আরসালান’-এর মোজাম্মেল হকও। তাঁর কথায়, ‘আমাদের কাছে সব চেয়ে বেশি চাহিদা স্পেশাল মাটন বিরিয়ানির। তার বিক্রিও কমেছে ৩০ শতাংশের বেশি। দুপুরের দিকে বসে খাওয়া প্রায় বন্ধই। রাতের অনলাইন অর্ডারের উপর আমরা অনেকটা নির্ভর করে আছি। তবে গরম বাড়লে অবস্থা যে এমনটা হবে, সেটা আমরা আগেই আন্দাজ করেছিলাম।’