এই সময়: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনও যে ক’জন আইকনিক মানুষ রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে চার নম্বর গেটের কাছে বইখাতা-ফটোকপির দোকান চালানো ‘তড়িৎদা’ একজন। আদতে দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুভাষগ্রামের বাসিন্দা তড়িৎ বরণ দাস গত ৩০ বছর ধরে এই চিপ স্টোর চালাচ্ছেন। অভাব তাঁর নিত্যসঙ্গী। কিন্তু তার মধ্যেও তড়িতের ছোট ছেলে সাত্ত্বিক দাস এবার মাধ্যমিকে দুর্দান্ত ফলাফল করেছে। যোধপুর পার্ক বয়েজ স্কুলের ছাত্র সাত্ত্বিক মাধ্যমিকে মোট ৬৬৪ নম্বর পেয়েছে। আর সে ওই স্কুলের দ্বিতীয় স্থানাধিকারী।মাত্র ১০-১২ হাজার টাকার মাসিক আয়ে সংসার চলে তড়িতের। সেই সংসারে সাত্ত্বিককে নিয়ে আছেন মোট চারজন। স্ত্রী, দুই পুত্রকে নিয়ে কোনও রকমে সংসার চলে দাস পারিবারের। কিন্তু হাজার ঝড়-ঝাপটা সহ্য করেও তার রেশ সন্তানদের উপর পড়তে দেন না তড়িৎ। তিনি নিজেও বিশেষ ভাবে সক্ষম। হাঁটার জন্য লাগে ক্রাচের সাহায্য। কিন্তু তা ছাড়া আর কোনও সাহায্যের জন্য শত অভাবেও হাত পাততে হয় না যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীদের প্রিয় এই তড়িৎদাকে।
সাত্ত্বিক ছেলেবেলা থেকেই পড়াশোনায় উজ্জ্বল। ক্লাসের পরীক্ষাতেও সে দারুণ ফলাফল করেছে। মাধ্যমিকে সব বিষয়েই তার ৯০ শতাংশের উপরে নম্বর। পড়াশোনার পাশাপাশি রবীন্দ্র সরোবরে ওয়াটার পোলোর তালিম নেয় সে। কলকাতা জেলার সাবজুনিয়র টিমে গোলকিপার হিসেবে প্রতিনিধিত্বও করে। তবে অনেকেই তাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। যেমন, প্রাইভেট টিউটররা। কেউ অল্প বেতন নিয়ে, কেউ বেতন না নিয়ে সাত্ত্বিককে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। সব সময়ে পাশে রয়েছে তার স্কুলও।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক অমিত সেন মজুমদার বলেন, ‘খুবই মেধাবী ছাত্র। ক্লাসেও কামাই করে না। কুইজ থেকে স্পোর্টস, নানা বিষয়ে ওর ইন্টারেস্ট রয়েছে। করোনার সময়ে সাত্ত্বিকের মতো অনেকেরই অনলাইন ক্লাস করার জন্য মোবাইল ফোন ছিল না। আমরা শিক্ষকরা তহবিল গড়ে ওদের সেই মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছি। তবে আসল লড়াইটা তো ওকে আর ওর পরিবারকেই লড়তে হচ্ছে।’
সাত্ত্বিক চায় আগামীদিনে ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করতে। বাবা তড়িৎ এবং দাদা সাগ্নিক দুজনেই যাদবপুরের ছাত্র। শিক্ষকদের ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় ১৯৯১ সালে এই চিপ স্টোরটি খুলতে পারেন তড়িৎ। কিন্তু ইদানিং বিশেষ করে অতিমারীর পর থেকে সেই ব্যবসায় মন্দা লেগেই আছে। তড়িৎ বলেন, ‘আজকাল তো আর কেউ ফটোকপি করে না। পিডিএফেই হয়ে যাচ্ছে। খাতা-পেনের জায়গাও নিয়ে ফেলেছে মোবাইল। আমার দুটো মেশিন এই ভাবেই পড়ে নষ্ট হয়ে গেল।’
কিন্তু তড়িতের এই দোকানকে প্রাণ দিয়ে আগলে রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনই। কেমন? তাঁর কথায়, ‘আমাকে সব ছাত্র সংগঠনের ছেলেমেয়েরাই খুব ভালোবাসে। ওরা আন্দোলনের জন্য পোস্টার, রং, তুলি, আঠা- এ সব কেনে। সেটাই এখন আমার মূল রোজগার হয়ে দাঁড়িয়েছে।’