• পড়ার ঘরে রবীন্দ্রনাথ
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ০৪ মে ২০২৪
  • সুব্রত চৌধুরী
    গত ক’দিন ধরেই কাঠফাটা গরম পড়ছে, তার ওপর বিদু্যতের লুকোচুরি খেলা৷ ছাতিফাটা গরমে টিকে থাকাটাই দায় হয়ে পডে়ছে৷ ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই অন্ত্ত ঘেমে নেয়ে উঠেছে৷
    অন্ত্তর আজকে স্কুল ও কোচিং সেরে বাসায় ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে৷ পড়ালেখার চাপে তার জেরবার অবস্থা৷ বাসায় ফিরে নাকে মুখে কিছু গুঁজেই আবার পড়ার টেবিলে৷ ক্লাসের ফার্ষ্ট বয় বলে কথা৷ কোথাও একটুকুন ফাঁক রাখার সুযোগ নেই৷ একটু ফাঁকি দিলেই চোখের পলকেই সব ফসকে যাবে৷
    আর মার যা পুলিশী তদারকি, ফাঁকি দেওয়ার সুযোগই নেই৷তাই সব সময় তাকে দৌডে়র ওপর থাকতে হয়৷ পড়ালেখার পাশাপাশি সৃজনশীল কর্মকান্ডেও তার সক্রিয়তা কারো অজানা নয়৷ শহরের তুখোড় বিতার্কিক, আঁকিয়ে হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছে অনেক আগেই, গানের গলাও মুগ্ধতার আবেশ ছড়ানোর মতো৷ বিশেষ করে রবীন্দ্র সংগীতটা সে বেশ ভালোই গায়৷
    স্কুলের হোমওয়ার্ক শেষ করতে করতে ঘডি়র কাঁটা দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে৷ গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটা ঢং ঢং শব্দে রাত নিশুতির কথা জানান দেয়৷ অন্ত্ত ঘন ঘন হাই তুলতে থাকে, চোখ দুটোর পাতা মুদে আসে৷হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের ছোঁয়া পেয়ে সে পেছনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়৷অন্ত্ত নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারে না৷ প্রথমে সে ভেবেছিল ঘুম ঘুম চোখে ভূল দেখছে না তো! ভালো করে চোখ দুটো রগড়িয়ে নেয় ৷ না ঠিকই তো , লম্বা জোব্বা গায়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন৷
    অন্ত্ত অবাক চোখে জিজ্ঞেস করে, রবিদাদু তুমি?
    : হ্যাঁ, বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি?
    ? সত্যিই দাদু বিশ্বাস হচ্ছে না৷
    : বিশ্বাস না হবারই কথা৷
    ? পাশের চেয়ারটাতে বসো রবিদাদু৷
    : তা এতো রাত পর্যন্ত কী পড়ছো? চেয়ারে বসতে বসতে রবি দাদু জিজ্ঞেস করেন৷
    ? স্কুলের হোমওয়ার্ক রেডি করছি৷
    : তাইতো দেখছি, গাদা গাদা বইতে টেবিল তো ভর্তি করে রেখেছো৷
    ? বেশিরভাগই তো দাদু রেফারেন্স বই৷
    :তাই!
    -হ্যাঁ দাদু৷
    : বইয়ের পড়া পডে় কী কেউ সত্যিকারের মানুষ হয়েছে খোকা?
    -তাহলে?
    : ইন্দ্রিয়চর্চা করতে হবে৷
    -কীভাবে ইন্দ্রিয়চর্চা করবো?
    : ইন্দ্রিয়চর্চার জন্য যেখানে খুশি ঘুরে বেড়ানো, ঘোড়ায় চড়া, মাছধরা, নৌকা বাওয়া, লাঠি-সড়কি খেলা, সাঁতার কাটা, ঘর গোছানো, রান্নায় সহযোগিতা করা ইত্যাদি বিষয়ে মনোযোগী হওয়ার কোনো বিকল্পই নেই৷
    -বেশ ইনটারেস্টিং তো! কিন্ত্ত শহরে এগুলো কোথায় পাবো?
    : তাইতো বলি সুযোগ পেলেই তোমাকে গ্রামে যেতে হবে৷ শহরের ছেলেমেয়েদের চেয়ে গ্রামের ছেলেমেয়েদের ইন্দ্রিয়ানুভূতি তুলনামূলকভাবে প্রবল হয়৷ কারণ, ব্যতিক্রমহীনভাবে তারা ওই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই বেড়ে ওঠে৷
    -হুম৷
    : তাছাড়া …
    -কী দাদু?
    : তোমরা তো প্রকৃতি থেকে শিক্ষা পাও না৷
    -ঠিক বলেছো দাদু৷
    : প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নিলেই সত্যিকারের মানুষ হতে পারবে ৷
    ? তাই!
    : হ্যাঁ ৷ তুমি শিলাইদহ কখনো গেছো?
    -কুঠিবাড়ির কথা বলছো?
    :হ্যাঁ ৷
    -বছর দুয়েক আগে মার সাথে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন উপলক্ষে
    শিলাইদহ গিয়েছিলাম৷
    : কুঠিবাড়ির পশ্চিমদিকে যে পুকুরটি আছে সেটা দেখেছো?
    -হ্যাঁ দেখেছি৷ পুকুরপাড়ের শান বাঁধানো ঘাটে বেশ কিছুক্ষণ বসে কাটিয়েছি৷
    : পুকুরপাড়ের সেই শান বাঁধানো বকুলতলার ঘাটে ফুলের সৌরভে ও পাখির কলরবে গান ও কবিতা লিখতাম৷
    -শান বাঁধানো ঘাটটি আমারও খুব পছন্দ হয়েছিল৷ সেই ঘাটে বসে আমি তোমার অস্তিত্ব অনুভব করেছিলাম৷যেদিকেই তাকাচ্ছিলাম দেখতে পাচ্ছিলাম যেন ‘তোমার পায়ের পাতা সবখানে পাতা৷’ আর কানে বাজছিল তোমার গানের সেই সুমধুর সুর “যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে”৷
    : পদ্মার বুকে যে বোটে আমি ভেসে বেড়াতাম সেই পদ্মাবোট তো নিশ্চয় দেখেছো৷
    ? হ্যাঁ দেখেছি৷
    : ওই পদ্মাবোটে পদ্মার বুকে চড়তে চড়তেই তো গীতাঞ্জলি কাব্যসহ অন্যান্য কাব্য রচনা করেছি৷ শিলাইদহেই আমি গীতাঞ্জলি কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ শুরু করি৷
    -আর সেই গীতাঞ্জলি কাব্যের জন্যই তো তোমার নোবেল পুরস্কার পাওয়া৷
    :ঠিক বলেছো৷
    -তোমার গর্বে আমরা দু’বাংলার বাংগালিরা গর্বিত রবিদাদু৷ তোমার জন্য বিশ্বসভায় আজো আমরা মাথা উঁচু করে চলি৷
    :শান্তিনিকেতন গেছো কখনো?
    -না,যাওয়া হয়নি, তবে যাওয়ার খুব ইচ্ছে আছে৷
    কথা বলতে বলতে গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটা ঢং ঢং শব্দে
    রাত নিশুতির কথা জানান দিতেই থাকে৷ আর তা শুনে রবিদাদু বলেন, কালকে সকালে তো তোমার স্কুল আছে, তাই না?
    -হ্যাঁ ৷
    : এখন ঘুমোতে যাও৷
    -ঠিক আছে৷
    : আমি আসছি৷
    -তোমার সাথে কথা বলে আমার খুব ভালো লেগেছে রবিদাদু৷
    : আমারও,আসি৷
    -আবার এসো রবিদাদু ৷
    হঠাৎ মার গলার শব্দে অন্ত্ত সম্বিৎ ফিরে পায়৷
    :কিরে রাত ক’টা বাজে খেয়াল আছে? এখনো ঘুমোতে যাসনি?
    -যাচ্ছি মা৷
    :এতোক্ষণ কার সাথে কথা বলছিলি?
    -কই! কারো সাথে না তো৷
    : আমি তোর ঘরে ঢুকতে ঢুকতে শুনতে পেলাম তুই কারো সাথে কথা বলছিস৷
    -রবিদাদুর সাথে মা৷
    : কী! তোর কী মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেছে?
    -মাথা খারাপ হবে কেন মা?
    : কবিগুরু সেই কবে মারা গেছেন! আর তুই বলছিস কিনা…
    -সত্যি মা, রবিদাদুর সাথেই কথা বলছিলাম৷
    : সত্যি! মা ভেংচি কাটতে কাটতে বলেন৷
    -‌ে তামার বিশ্বাস হচ্ছে না মা?
    : আর বিশ্বাস করতে হবে না৷যা, এখন ঘুমাতে যা, অনেক রাত হয়েছে৷ আমি দরজাটা বাইরে থেকে ভেজিয়ে দিচ্ছি৷
    অন্ত্ত খাটে শুতে গিয়েই হঠাৎ তার চোখ আটকে যায় পড়ার ঘরের দেওয়ালে ঝুলানো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবির ওপর৷ কবিগুরুর ছবিটার ওপর তাজা ফুলের মালা ঝুলছে, মা কখন যে পরিয়ে দিয়েছেন৷ রাত পোহালেই তো রবীন্দ্র জয়ন্তী৷
    ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যেতে যেতে অন্ত্তর কানে বাজতে থাকে, “আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে?, আছে সে নয়নতারায় আলোকধারায় …৷”
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)