• ট্রাকে চড়ে বউ যাচ্ছে শ্রমিক হতে
    এই সময় | ০৫ মে ২০২৪
  • বিয়ে করো। মানে বিয়ে সারো। হল? সময় নেই আর। রওনা দাও। ট্রাক লোড হয়েছে? হয়নি? কেন? এখনও হয়নি? কেন? জলদি করো জলদি। আখ কাটতে হবে, শুকিয়ে গেলে রস আসবে না। আমরা দু’জন মিঞা বিবি এখন, এ বার যাব ‘গেট-কেন’। ওখানেই বাসর। আমাদের বিয়েটাও তো ‘গেট-কেন’। ‘গেট-কেন’ বোঝো না? আখের ক্ষেতের গেট, তার সামনে দাঁড়াবে ট্রাক। আমরা লেবার। শ্রমিক, জোড়ায় জোড়ায়, সুখের পায়রা, দুখের পায়রা।আমরা বর বউ, আমরা ‘গেট-কেন’ই আমাদের সংসার, ওখানেই কাজ, ওখানেই সোহাগ। বিয়ে হয়েছে কতক্ষণ? ২৪ ঘণ্টা? ৩০ ঘণ্টা? ঘটিবাটি জিনিসপত্তর নিয়ে দিব্যি পৌঁছে গেছি আখের কলের গেটে। যা দরকার সবই তো এসেছে ট্রাকে। জামাকাপড়, বাক্সপ্যাঁটরা, বাসনকোসন, খাট বিছানা, হাঁড়ি-পাতিল, যৌতুকের স্কুটারটা নিতেও তো ভুলিনি। মায় ছাগল ক’টাও তো নিয়ে এসেছি। একটু জিরিয়ে নিই। কাল থেকে কাজ শুরু। আমাদের দু’জনের।

    মহারাষ্ট্রের মারাঠাওয়াড়া এলাকাটি বহু দশক ধরেই খরাপ্রবণ। তীব্র তাপপ্রবাহ, জলসঙ্কটের কারণে এখানকার মানুষের জীবিকার টানাটানি বহু দিনের। ফলত, বিকল্প বলতে একটাই থাকে। সেটা হল, রাজ্যের অন্যান্য জায়গায় কাজের জন্য চলে যাওয়া। বিশেষ করে আখ কাটার কাজে জুতে যাওয়া। জোড়ায় জোড়ায়। কারণ আখশিল্প শ্রমনিবিড়। যত মানুষ, তত উৎপাদন। আখচাষের পর পরই আখকাটার ঠিক আগে আগে হয়ে যায় বিয়ে। যেন একটা ওয়ান ডে ম্যাচ! বিয়ে করেই ‘গেট-কেন’ এ গাড়ি দাঁড়াবে। তাই বিয়ের নাম এই।

    আর দম্পতিরা? তারা ‘কয়টা’ মানে কাস্তে। ওই যে, আখ কাটবে, তাই। প্রতি টন আখ কাটায় মিলবে ২৫০ থেকে ৩২০ টাকা। যে মেয়েটি সদ্য বিয়ে হয়ে এল তার স্বামীর সঙ্গে, সে তো স্বামীর ঘর করবেই, তার সঙ্গে স্বামীর সহায়ক হিসেবে কাজ করবে আখ ক্ষেতে। সত্তরের দশক থেকেই মারাঠাওয়াড়া এলাকায় খরার আধিক্য মেয়েদের এই ধরনের সামাজিক শ্রমে যুক্ত হওয়ার দিকে ঠেলে দিয়েছে। তারাও পেটের দায়ে বিয়ে করে চলে যাচ্ছে রাজ্যের অন্যত্র, আখের ক্ষেতে। বিয়েও হবে, পেটও ভরবে।

    খরা এলাকায় পুরুষরা যখন বছরে ছ’সাত মাসের জন্য অন্যত্র কাজে যাচ্ছেন, মেয়েরাই বা একা কী করে ঘরগেরস্থালি সামলাবে? তার চেয়ে পুরুষের স্ত্রী হয়ে কাজে যাওয়ার সুযোগটা মন্দের ভালো। এক তো আখশিল্পে প্রচুর শ্রমিকের চাহিদা, অর্থাৎ স্বামীর সহায়ক হিসেবে কাজ করলেও ঘর সংসার করে মোটামুটি খাওয়া-পরাটা চলবে। আর সেই নিরাপত্তার জন্য এই সব অঞ্চলে কম বয়সে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেওয়াটাও একটা চল, আসলে বাধ্যতা।

    বিয়ে হয় বটে দুই পরিবারের সম্মতিতে, কিন্তু মাঝে রয়েছে আড়কাঠি। কন্ট্র্যাক্টর। তারাই চাষের মরসুমে প্রায় এক লাখ অগ্রিম টাকা দেয় সংশ্লিষ্ট দুই পক্ষকে, বিয়ের জন্য। তার পরে, দম্পতির কাজ হল, ওই টাকা কাজ করে শোধ করা। মানে কন্ট্র্যাক্টরই আরও শ্রমিকের চাহিদার কারণে অগ্রিম টাকা দিয়ে বিয়ে দিল, তাদের ঋণের সূত্রে বাঁধল এবং তার পরে ধারের টাকা আদায় করার জন্য ইচ্ছামতো ওই দম্পতিকে দিয়ে খাটালো।

    এর পরেও যদি দম্পতি না পারে টাকা শোধ করতে, তারা বাধ্য হবে পরিবারের অন্যদেরও এই আখ ক্ষেতে শ্রমিক হিসেবে সাপ্লাই দিতে। আবারও একটা গেট-কেন বিয়ে। চক্রব্যূহের মতো— ঢোকা যায়, বেরোনো যায় না। ২০১৯-২১ এর ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে অনুযায়ী, মারাঠাওয়াড়া এলাকার ৪৩ শতাংশ নারীরই বিয়ে হয়েছে ১৮ বছরের আগে। ২০১০ থেকে ২০২০ সালে এই এলাকায় পরের পর খরা দেখা যায়, বাল্যবিবাহ বাড়ে ২০ শতাংশ।

    তুমুল জলসংকটের কারণে এলাকার মানুষ কাজের সন্ধানে অন্যত্র যেতে বাধ্য হন। মজার ব্যাপার হল, এই বছরগুলিতে মহারাষ্ট্রে আখের উৎপাদনও বৃদ্ধি পায় সাতগুণ। অতঃপর দু’টি পরিসংখ্যানের মধ্যে সম্পর্কসূত্রটি তৈরি করা অতঃপর কঠিন নয়। কী ভাবে এক কথায় দু’এক দিনের নোটিশে হয়ে যায় এই বিয়ে? খুব অল্প সংখ্যক মানুষকে খাওয়ানো হয়, গ্রামেরই কয়েকজন। যৌতুক কেনা হয়। মণ্ডপ নেই, কার্ড ছাপানো নেই, অতিথি বলতেও দু’একজন। এমনকী বিয়ের তেমন অনুষ্ঠানও নেই।

    আছে বলতে মন্দিরে গিয়ে মালাবদল। তার পরে কন্ট্র্যাক্টরের হাত থেকে পাওয়া ক’টা টাকা। বিয়ে উপলক্ষ্যে সে দিন সন্ধেয় মদ, মাংসের সামান্য আয়োজন। ব্যস। তার পরেই লেগে পড়ো কাজে। চলো আখের ক্ষেতে। স্থানীয় ভাষায় ‘গেট-কেন কেলে’ বা ‘গেট-কেন বিয়ে’। কার সাথে কার বিয়ে হবে সেটা ঠিক হয় কোনও প্রেম-ভালোবাসা দিয়ে নয়, বরং জাত কী, পরিবারে ক’টা মেয়ে আছে, পণের পরিমাণ কী, এলাকায় ভূগর্ভস্থ জলের পরিমাণ কত, জমির মালিকানার ধরণ কী, আর মেয়ে যে পরিবারে ‘দেওয়া’ হচ্ছে, আর যে পরিবার ‘নিচ্ছে’ তাদের সম্পর্ক কী রকম তা দিয়ে ঠিক হয় বিয়ের কথা। বিয়ের খরচও একটু কম।

    অন্য জায়গা, অন্য সময় হলে এক মেয়ে ‘পার করতে’ই কতটা কী খরচ হত! বিয়ে হওয়া বেশির ভাগ মেয়ের বয়সই ১৫ থেকে ১৯ এর মধ্যে। এলাকার তথাকথিত শিক্ষিত শ্রেণি, বিশেষ করে স্কুল মাস্টার বা সরকারি অফিসাররা এই ধরনের বিয়ের খবর পেলে তা আটকানোর চেষ্টা করেন বটে। কিন্তু পেট বড় বালাই। খরা বিধ্বস্ত এলাকায় ঔচিত্য, অনৌচিত্য, নারীর শরীর, শরীরের প্রাপ্তবয়স্কতা, দেশের আইনের মতো ফ্যাক্টরগুলি সে ভাবে কাজ করতে পারে না। হেরে যায়।

    এলাকার এক চাইল্ড প্রোটেকশন অফিসার বলছেন, ‘জানি না, ‘গেট-কেন’ শব্দটা হিন্দি না মারাঠি নাকি ইংরেজি। কিন্তু শব্দটা এই অঞ্চলেই চলে, কেন-ইন্ডাস্ট্রি’-তে। বিয়ে এখানে ‘ঝটপট’ নামেও পরিচিত।’ স্বাভাবিক ভাবেই এই বিয়েগুলির বেশিরভাগই সরকারি খাতায় নথিবদ্ধ হয় না। হওয়ার চান্স নেই। মুখে বিয়ে, আদতে লেবার সাপ্লাই। বিয়ের মরসুমে বিয়ে নয়, এখানে আখের মরসুমই বিয়ের মরসুম। আখ কাটার আগে আগে চলে যাও গ্রামে, বিয়ে করে নিয়ে এসো বউকে। তার পর তুমি নতুন ‘কয়টা’।

    আখের রসে মিশে যায় বাল্যবিবাহ, মানুষের বিবাহ-রোম্যান্সের নির্যাস নিংড়ে বার করে আনা যৌথ শ্রম। আখ বাড়ে, লাভের গুড়ও বাড়ে। কয়টাদের বিবাহস্মৃতি বলতে থেকে যায় ট্রেলার ট্রাক, তাতে ভর্তি বাসনকোসন, খাটবিছানা, গরুছাগল আর তাজা মেহেন্দিতে রাঙানো হাতে ধরা কাস্তে। উঁহু, ওরাই কাস্তে।
  • Link to this news (এই সময়)