DY Chandrachud: 'শরীরের ক্ষত সারে, কিন্তু মনের?' স্মৃতি হাতড়ে প্রশ্ন সিজেআই-এর
এই সময় | ০৬ মে ২০২৪
নয়াদিল্লি ও কলকাতা: তাঁর বক্তব্য —‘আসলে শরীরের ক্ষত সেরে যায়, কিন্তু (নেপথ্যের ঘটনাটা) মনে দীর্ঘকালীন ছাপ রেখে যায়।’ তিনি — সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। একটা সময় ছিল, যখন স্কুলের দিনগুলোতে মাস্টারমশাইয়ের হাতে মার খায়নি, তেমন খুদে খুঁজে পাওয়াই ছিল কঠিন। সিজেআই চন্দ্রচূড়ও যে তার ব্যতিক্রম নন, এক সেমিনারে জানালেন সে কথাই। একই সঙ্গে ছোট ছোট কর্পোরাল পানিশমেন্ট ছোটদের মনে কতটা প্রভাব রেখে যায়, আরও একবার তা নিয়ে মাথা ঘামাতে এক রকম বাধ্যই করলেন।কাঠমান্ডুতে নেপালের সুপ্রিম কোর্ট আয়োজিত একটি সেমিনারে যোগ দিতে তিন দিনের সফরে গিয়েছেন সিজেআই চন্দ্রচূড়। এই প্রথম ভারতের কোনও প্রধান বিচারপতি নেপালের চিফ জাস্টিসের আমন্ত্রণে সফরে গিয়েছেন সে দেশে। সেমিনারের আলোচ্য বিষয় - ‘জুভেনাইল জাস্টিস’।
এ নিয়ে কথা বলতে গিয়েই নিজের স্কুলজীবনের স্মৃতি তুলে ধরেন চিফ জাস্টিস। তখন তিনি ক্লাস ফাইভে। একটা ছোট্ট ঘটনাতেই হাতে জুটেছিল বেতের মার! লাল হয়ে যাওয়া সেই হাত লজ্জায় বাবা-মায়ের সামনে দেখাতে পারেননি সিজেআই। সেমিনারে বিচারপতি বলেন, ‘বাচ্চাদের সঙ্গে ছোটবেলায় কী ব্যবহার করা হচ্ছে, তার দীর্ঘকালীন প্রভাব তাদের জীবনে পড়ে। আমি স্কুলের সেই দিনটার কথা ভুলব না। স্কুলে ক্রাফ্টের ক্লাস ছিল, একটা নির্দিষ্ট মাপের সুচ দরকার ছিল অ্যাসাইনমেন্টের জন্য। কিন্তু আমি সেটা নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলাম। শিক্ষক একটা বেত নিয়ে আমার হাতে মারতে যান।’
তারপর? সিজেআইয়ের কথায়, ‘এখনও মনে আছে, শিক্ষককে বলেছিলাম, হাতে নয়, পিছনে মারুন। কিন্তু তিনি শোনেননি। হাতেই বেত দিয়ে মারতে থাকেন। লাল লাল দাগ হয়ে গিয়েছিল। লজ্জায় বাবা-মাকে বলতে পারিনি মার খাওয়ার কথা। দিন দশেক বাবা-মায়ের সামনে ডান হাতটা খুলে দেখাতেও পারিনি।’ এই সূত্রেই শরীরের ক্ষত সারলেও মনে ছাপ থেকে যাওয়ার কথা আরও একবার জানান চিফ জাস্টিস। বলেন, ‘বাচ্চাদের মনে এ ধরনের ঘটনার প্রভাব পড়ে মারাত্মক। তাই আইনি ঝামেলায় জড়িয়ে যাওয়া বাচ্চাদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রেও আমাদের অনেক বেশি সংবেদনশীল হতে হবে।’
সিজেআইয়ের মতে, পারিবারিক হিংসা, বাবা-মায়ের অশান্তি, দারিদ্র্য-সহ নানা কারণে বাচ্চাদের মধ্যে অপরাধের মানসিকতা তৈরি হয়। কখনও আবার প্রতিবন্ধী শিশুদের অপরাধ জগতে ব্যবহার করে ক্রিমিনালরা। তাই, বাচ্চাদের অপরাধে বিচারের ক্ষেত্রে তাদের মনে প্রভাব, ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। একই সঙ্গে তাঁর আক্ষেপ — ভারতে জুভেনাইল ডিটেনশন সেন্টারগুলিতে চরিত্র সংশোধনের পর্যাপ্ত পরিকাঠামো নেই।
আসলে অনেক সময়েই একটা কথা বলা হয় — শিশুমন পরিষ্কার স্লেটের মতো। তাতে যেমন আঁক কাটা হয়, তারই ছাপ থেকে যায়। সে দিক থেকে প্রধান বিচারপতির বক্তব্যে সহমত অনেক বিশেষজ্ঞও। বিশেষত যাঁরা শিশুদের নিয়ে জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন বা কাটান। ভয় দেখিয়ে, মারধর করে বাচ্চাদের নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। বরং ভালোবাসাই আসল ‘হাতিয়ার’। সিজেআই যে সময়ের কথা বলেছেন, তারপরে অনেকটা পথ পেরিয়ে আসা হয়েছে। কর্পোরাল পানিশমেন্টের বিরুদ্ধে এখন অভিভাবকরাও অনেক বেশি সোচ্চার। আইন করে একে নিষিদ্ধও করা হয়েছে। তবু কি বদলেছে পরিস্থিতি?
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রাম তা মনে করেন না। তাঁর বক্তব্য, ‘পশ্চিমবঙ্গে বাচ্চাদের উপর শারীরিক হেনস্থার ছবিটা যে কী ভয়াবহ, সেটা ধারণার বাইরে। পরিবারের মধ্যে বাচ্চারা স্কুলের তুলনায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এতে শিশুমনে ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। অ্যান্টি সোশ্যাল ভাবনাচিন্তা এ ভাবেই তো শিশুমনে গেঁথে দেওয়া হচ্ছে! ওরাও শিখছে যে রাগ হলে মারধর করাটাই নিয়ম। সেটাই পরে প্র্যাকটিস করবে।’
এ ক্ষেত্রে শাসনের চেয়ে শাসনের ভান করাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক প্রশান্ত রায়। শিশুদের গায়ে স্পর্শ না করে তাদের উপরে রাগের অভিনয় করলেও ছোট্ট মাথা, ছোট্ট মনে অনেকখানি প্রভাব পড়ে বলে মনে করেন এই প্রবীণ প্রফেসর। তাঁর কথায়, ‘মারধর করে কিন্তু সেই কাজটা হয় না।’ অনেক স্কুলে এ কারণে ‘নো টাচ পলিসি’ নেওয়া হয়েছে।
যেমন ডিপিএস নিউ টাউন। সেখানকার দীর্ঘদিনের অধ্যক্ষা সোনালি সেন অন্যদিক থেকে বিষয়টাকে বিশ্লেষণ করছেন। তিনি দেখছেন বড়দের মানসিকতা থেকে। সোনালির কথায়, ‘যে শিক্ষকরা বাচ্চাদের মারধর করেন, তাঁরা কিন্তু শেখানোর জন্য মারেন না। তাঁরা মারেন নিজের রাগ, হতাশা প্রকাশ করতে। বাচ্চারা সফ্ট টার্গেট। এ ভাবে তাদের কিছুই শেখানো যায় না। বরং হিতে বিপরীত হতে পারে।’
সকলেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ভালোবাসা-যত্ন-স্নেহ আর অনেকটা বোঝাপড়া — শিশুদের বড় হওয়ার পথে এর বিকল্প কিছুই হয় না। প্রশান্ত বলেন, ‘যখন কোনও কাচের জিনিস ডেলিভারি করা হয়, তখন প্যাকেজে লেখা থাকে ‘হ্যান্ডল উইথ কেয়ার!’ বাচ্চাদের জন্যও সেটা প্রযোজ্য।’ তা হলে আর কোনও শিশুকে সিজেআইয়ের মতো বাবা-মায়ের কাছে হাত গুটিয়ে থাকতে হয় না...তাই না?