মিয়ানো তুবড়ির মতো ভোট এখানে, মিস করি বাংলার উত্তাপ
এই সময় | ০৭ মে ২০২৪
শর্মিষ্ঠা গোস্বামী, টরন্টো
ক্যানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বিশ্বের সম্ভবত সবচেয়ে সুদর্শন রাষ্ট্রপ্রধান। মানে, তেমনটাই বলা হয়ে থাকে। ক্যানাডা আমেরিকার ঠিক পাশের দেশ হলেও হাঁকডাক বা দাদাগিরিতে আমেরিকার ধারে কাছেও আসে না বিশাল আর সুন্দর এই দেশটি। সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে খালিস্তান ইস্যু নিয়ে কয়েক পর্বের তাল ঠোকাঠুকি হওয়ার পরে জাস্টিন ট্রুডো ভারতেও বেশ এক পরিচিত নাম হয়ে গিয়েছেন।ট্রুডোর রাজনৈতিক দলের নাম লিবারাল পার্টি। অন্য প্রধান রাজনৈতিক দলটির নাম কনজারভেটিভ পার্টি। এখন ক্যানাডায় কাজের বাজার খারাপ, মাথার উপর ছাদ জোগাড় করতে মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা মোটেই আশানুরূপ নয়। তার উপরে বিদেশি শরণার্থীদের জন্য দরজা খুলেই রেখেছেন ট্রুডো। ফলে, ক্যানাডিয়ানদের একটা বড় অংশ ট্রুডোর উপর অসন্তুষ্ট, সেটা সমাজমাধ্যম ও মেনস্ট্রিম মিডিয়ার আলোচনা শুনলেই বোঝা যায়। এর মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন কনজারভেটিভ পার্টির নেতা পিয়ার পলিয়েভার। আগামী বছর, ২০২৫ সালে ক্যানাডার ফেডেরাল ইলেকশন। তাতেই নির্ধারিত হবে ট্রুডোর ভাগ্য।
আমি ক্যানাডার বেশ কয়েকটি ভোট দেখেছি। যেমন ঠান্ডা দেশ, তেমনই ঠান্ডা নির্বাচনী-আবহ। টেলিভিশনে সম্প্রচারিত নেতাদের বক্তৃতা ছাড়া, প্রচারে আমি আর তেমন কিছু দেখিনি। পাড়ায় পাড়ায় শুধু প্রার্থীর ও দলের নাম আর ছবি দেওয়া ছোট সাইজ়ের ব্যানার ঘাসের উপর গেঁথে দিয়ে যায় পার্টির লোকেরা। কোনও দেওয়াল লিখন, পথসভা, মিছিল, গলা ফাটানোর গল্পই নেই। ভোটের দিন একটা পরিচয়পত্র নিয়ে গিয়ে নির্দিষ্ট কেন্দ্রে ব্যালটটিতে ছাপ দিয়ে বাক্সে ভরে দিয়ে আসতে হবে। না থাকে পুলিশ, না থাকে বন্দুক উঁচোনো নিরাপত্তাবাহিনী। যদি খেয়াল না রাখেন, তা হলে আপনি জানতেও পারবেন না কবে ভোট এল আর চলে গেল!
আর এখানেই আমার মতো প্রবাসীর বড্ড কেমন কেমন লাগে। সেঁতিয়ে যাওয়া দোদমার মতো, ফুস করে নিভে যাওয়া তুবড়ির মতো, নেতানো মশলার জন্য না-ফাটা চকোলেট বোমের মতো ক্যানাডার ভোট। পাশাপাশি, আমাদের দেশের ভোট দেখুন। সেই কবে থেকে, ‘শুন্ডির দেব পিণ্ডি চটকে’ পর্ব চলছে। সত্যি বলছি, তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার মতো ভোট ভারতবর্ষের।
ক্যানাডায় আসার আগে আমার দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে বেশ কয়েকটি বিধানসভা ও লোকসভা ভোট কভার করেছি। আরামবাগ আর বীরভূমে একাধিকবার গিয়েছি ভোট কভার করতে। কলকাতার কথা বাদই দিলাম। সেই আরামবাগ যেখানে সিপিএমের অনিল বসু দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মার্জিনে জিতেছিলেন। ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়া কাকে বলে দেখেছি। ছাপ্পা দেখেছি, বোমাবাজি, ইট ছোড়া দেখেছি।
এসি-হীন অ্যাম্বাস্যাডরের মধ্যে গরমে সেদ্ধ হয়ে মাইলের পর মাইল গিয়ে প্রার্থীর সঙ্গে ভাঁড়ে গরম লাল-চা খেয়ে প্রচারে হেঁটেছি। পিছনে হেঁটেছে কোলে ছাগল নিয়ে ঘোমটা দেওয়া বউ, লুঙ্গি পরা চাচা, মুখে আঙুল পোরা বাচ্চাদের দল। সত্যি-মিথ্যের গল্পে, মেঠো উষ্ণতায়, নরমে-গরমে সেই সব ভোটের প্রচারে ‘সোশ্যাল মিডিয়া’ আর ‘ভাইরাল’ নামে শব্দ দুটো অপরিচিত ছিল।
ক্যানাডার রাতের দিকে ভারতে সকাল হয়। তখন সবক’টা বাংলা আর হিন্দি চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখি। জানি না বয়স হচ্ছে বলে কি না, মনে হয় অকারণে টিভির অ্যাঙ্করেরা প্রচণ্ড চেঁচান। সকাল সকাল সাত-আট জনকে নিয়ে একটা কলহ-আসর বসে। কে, কী বলছেন, কিছুই প্রায় বোঝা যায় না। যে ভাষায় নেতা-নেত্রীরা পরস্পরকে আক্রমণ করেন, সেগুলো এখন একটু বেশিই কানে লাগে।
তবু টিভিতে চোখ রাখি বা নিউজ-পোর্টাল পড়ি—একটু তাত অনুভব করার জন্য। মনে পড়ে, মে মাসের গরমে ভোটের দিন দুপুরে মল্লিকবাজারের ভাতের হোটেলে আমার সহকর্মীর সঙ্গে ভাত, ডাল, পেঁয়াজ, শসা আর লেবুর টুকরো দিয়ে লাঞ্চ করার কথা। সেই লাঞ্চ শেষ হতে না হতেই বেলেঘাটায় বোমাবাজির খবরে দৌড়েছিলাম আমরা।১৪০ কোটির দেশে ভোট যেমন হওয়ার তেমনই হচ্ছে। সমালোচনা করা সোজা, কিন্তু ভারতের মতো অনন্য দেশে ভোট করা মোটেই সহজ নয়। তাই মিস করি, সত্যিই মিস করি ভারতের ভোটপর্ব!