এই সময়: লোকসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে অন্তর্বর্তী জামিন দেওয়া হবে কি না, সেই বিষয়টি ৭ মে (মঙ্গলবার) বিবেচনা করে দেখা হবে বলে জানিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু অন্তর্বর্তী জামিনের শুনানির ঠিক আগের দিন রাজধানীর রাজনীতিতে নয়া ট্যুইস্ট! নিষিদ্ধ খালিস্তানি সংগঠন ‘শিখস ফর জাস্টিস’-এর থেকে রাজনৈতিক অনুদান নেওয়ার অভিযোগে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে এনআইএ তদন্ত চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে চিঠি লিখলেন দিল্লির উপ-রাজ্যপাল ভি কে সাক্সেনা! কেজরির দল ‘আম আদমি পার্টি’(আপ)-এর অবশ্য দাবি, উপরাজ্যপাল আদতে বিজেপির এজেন্ট! পুরোটাই কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে নতুন একটা ষড়যন্ত্র।দিল্লির আবগারি দুর্নীতি মামলায় গত ২১ মার্চ কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তার করে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। এখন তিহাড় জেলে বন্দি কেজরিওয়াল। ভোটের মুখে তাঁর গ্রেপ্তারি আদতে ‘রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র’, এই যুক্তিতে জামিনের আর্জি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন কেজরি। ৩ মার্চ শুনানিতেই সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল, জামিনের সওয়াল-জবাব যদি দীর্ঘমেয়াদি হয়, তবে ভোটের কথা মাথায় রেখে কেজরির অন্তর্বর্তী জামিন মঞ্জুর করতে পারে আদালত। সওয়াল-জবাবের জন্য ইডিকে মঙ্গলবার তৈরি হয়ে আসতেও বলেছিলেন বিচারপতিরা। ঠিক তার আগেই প্রকাশ্যে এলো ৩ মে উপ-রাজ্যপালের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারির লেখা এই চিঠি।
কী বলা হয়েছে সেই চিঠিতে?
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে লেখা চিঠিতে সাক্সেনার সেক্রেটারির দাবি, গত ১ এপ্রিল ‘ওয়ার্ল্ড হিন্দু ফেডারেশন ইন্ডিয়া’র ন্যাশনাল জেনারেল সেক্রেটারি আশু মোঙ্গিয়ার থেকে একটি অভিযোগ পেয়েছিলেন দিল্লির উপরাজ্যপাল। খালিস্তানি নেতা গুরপতবন্ত সিং পান্নুনের একটি ভিডিয়ো বার্তা উল্লেখ করে আশুর দাবি ছিল, পান্নুনের খালিস্তানি সংগঠন ‘শিখস ফর জাস্টিস’-এর থেকে ১.৬ কোটি ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১৩৩ কোটি টাকা) অনুদান পেয়েছে কেজরিওয়ালের দল আপ।
২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে অনুদান দেওয়া হয়েছে। ২০১৪ সালেই নিউ ইয়র্কের রিচমন্ড হিলসের গুরুদ্বারে খালিস্তানি নেতাদের সঙ্গে কেজরিওয়ালের রুদ্ধদ্বার বৈঠকও হয়েছে বলে দাবি। সেখানে রাজনৈতিক অনুদানের বিনিময়ে দেবেন্দর পাল ভুল্লারের মুক্তির ব্যাপারটি নিয়ে তদ্বির করার আশ্বাস দিয়েছিলেন কেজরি।
প্রসঙ্গত, প্রাক্তন প্রফেসর ভুল্লার ১৯৯৩ সালের দিল্লির বোমা বিস্ফোরণ মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন। ২০০১ সালে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, পরে তা কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয়। সেই ভুল্লারের প্রসঙ্গ উপ-রাজ্যপালের সেক্রেটারির লেখা চিঠির ছত্রে ছত্রে রয়েছে। তাঁর দাবি, হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের নেতা আশু মোঙ্গিয়া তাঁর অভিযোগপত্রের সঙ্গে কিছু ছবিও পাঠিয়েছিলেন। আপের কর্মী মুনিশ কুমার রাইজ়াদা-ই নাকি রিচমন্ড হিলে কেজরিওয়াল ও খালিস্তানপন্থী নেতাদের বৈঠকের ওই ছবিগুলো এক্স প্রোফাইলে শেয়ার করেছিলেন।
আশুর দাবি, কেজরিওয়াল নিজেই ভুল্লারের সাজা মকুবের অনুরোধ নিয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে চিঠি লিখেছিলেন। অভিযোগপত্রের সঙ্গে একটি চিঠির কপিও নাকি শেয়ার করেছেন আশু। সেই চিঠিতে ইকবাল সিং নামে এক ব্যক্তিকে ২০১৪ সালের ২৭ জানুয়ারি কেজরি লিখেছিলেন, ‘দিল্লির আপ প্রশাসন ভুল্লারের ব্যাপারে সহমর্মী। তাঁকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতে সব রকম পদক্ষেপ করব আমরা। দিল্লি প্রশাসন এ ব্যাপারে ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপতিকে চিঠিও লিখেছে।’
দিল্লির উপরাজ্যপালের সেক্রেটারির বক্তব্য, ‘ছবি, চিঠি-সহ এই অভিযোগপত্র উপরাজ্যপালের কাছে পাঠিয়ে কেজরির বিরুদ্ধে খালিস্তানি অনুদান নেওয়ার অভিযোগের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করেছিলেন আশু। একজন মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আর সেটাও নিষিদ্ধ একটি জঙ্গি সংগঠনের থেকে লাখ লাখ টাকা নেওয়ার। বিষয়টির গুরুত্ব, সংবেদনশীলতা মাথায় রেখেই দিল্লির উপরাজ্যপাল চান— স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এই বিষয়ে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-কে তদন্তভার দিক।’
কেজরিওয়ালের অন্তর্বর্তী জামিনের শুনানির ঠিক আগের দিনই উপ-রাজ্যপালের এই চিঠিতে রাজনৈতিক অঙ্ক দেখছেন অনেকেই। বিরোধী শিবিরের দাবি, মঙ্গলবার অন্তর্বর্তী জামিন পেলে ২৫ মে দিল্লির ভোটের আগে নির্বাচনী প্রচারের সুযোগ পেয়ে যাবেন কেজরিওয়াল। সেই প্রচার আপকে ভোটে ফায়দা দিতে পারে, এই আশঙ্কাতেই ভুগছে বিজেপি। আর তাই দিল্লিতে কেন্দ্রের নিযুক্ত উপ-রাজ্যপাল এখন অন্য একটি মামলায় কেজরির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করাতে চাইছেন। ১ এপ্রিল তিনি আশু মোঙ্গিয়ার চিঠি পেয়ে থাকলে এতদিন পর কেন তদন্ত শুরুর কথা বললেন—প্রশ্ন বিরোধী শিবিরের।
আপ নেতা তথা দিল্লির মন্ত্রী সৌরভ ভরদ্বাজের দাবি, ‘উপরাজ্যপাল স্যর বিজেপির এজেন্ট। এটা কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে বিজেপির আরও একটা ষড়যন্ত্র। দিল্লিতে সাতটা আসনেই বিজেপি হারবে, সেটা বুঝেই ওরা দিশেহারা হয়ে গিয়েছে। পাঞ্জাবের বিধানসভা ভোটের আগেও এমনই ষড়যন্ত্র করেছিল বিজেপি। আর ভোটের মরশুমে এলজি সাহেব যে কোনও মূল্যে শিরোনামে আসতে চাইছেন। এই অভিযোগেই উচ্চপর্যায়ের তদন্ত চেয়ে দু’বছর আগে একটা জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছিল। দিল্লি হাইকোর্ট মামলাটিকে ভিত্তিহীন বলে খারিজ করে দিয়েছিল। তা হলে এখন আচমকা তদন্তের প্রশ্ন আসছে কেন?’