ধর্ষকের সন্তান জন্মে বাধ্য করা যায় না নির্যাতিতাকে: কেরালা হাইকোর্ট
এই সময় | ০৭ মে ২০২৪
এই সময়: কোনও মেয়ে বা মহিলা যদি ধর্ষণের শিকার হন ও তার ফলে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন, তাঁকে কোনও অবস্থাতেই ধর্ষকের সন্তানের জন্ম দিতে বাধ্য করা যায় না। সেটা করলে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১-এ যে ‘মর্যাদা-সহ জীবনধারণের অধিকার’ (রাইট টু লাইফ উইথ ডিগনিটি) উল্লিখিত আছে, সেই মৌলিক অধিকারকে খর্ব করা হয়। পাশাপাশি, তাকে মারাত্মক মানসিক চাপ (ট্রমা)-র মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়। ফলে ২৮ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা ক্লাস ইলেভেনের কিশোরীকে গর্ভপাতের অনুপতি দিয়েছে কেরালা হাইকোর্ট।এই রায় ঘোষণা করার সময়ে বিচারপতি কওসর এডাপ্পাগাথ এই ব্যাখ্যা দিয়েছেন। গত সপ্তাহেই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ এক কিশোরীকে ৩০ সপ্তাহে গর্ভপাতের অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু পরে সেই রায় বেঞ্চ ফিরিয়ে নেয়, কারণ মেয়েটির জীবনসঙ্কট হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। মেয়েটি যথা সময়েই সন্তানের জন্ম দেবে।
সোমবার কেরালা হাইকোর্ট বিস্তারিত রায়ে জানায়, এই কিশোরী তার বয়ফ্রেন্ডের প্রতারণার শিকার হয়েছে। অভিযুক্ত নানা অছিলায় মেয়েটিকে বারবার ধর্ষণ করে ও তার ফলে সে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় তাকে সন্তানের জন্ম দিতে বলার অর্থ তার উপরে জোর করে মাতৃত্ব চাপিয়ে দেওয়া। আর সেটা যেই মুহূর্তে করা হবে তখনই মেয়েটির ‘মর্যাদাপূর্ণ জীবনধারণের’ সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হবে।
বিচারপতি বলেন, ‘যৌন নির্যাতনের পরে কেউ যদি গর্ভবতী হয়ে পড়েন, তা সারা জীবনের মতো ট্রমা হিসেবে থেকে যায়। যা ওই অন্তঃসত্ত্বার ফিজ়িক্যাল হেলথ ও মেন্টাল হেলথের উপরে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। যৌন নির্যাতন বা যৌনতার সুযোগ নেওয়া এমনিতেই অত্যন্ত পীড়াদায়ক, তার উপরে যদি তিনি গর্ভবতী হয়ে পড়েন, সেটা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে। কারণ এই প্রেগন্যান্সি না পরিকল্পনামাফিক না স্বেচ্ছায়।’
এ দিনের শুনানি শুরুর আগেই অবশ্য হাইকোর্ট এক পর্যবেক্ষণে বলে, ‘রিপ্রোডাক্টিভ রাইটসে একজন মহিলাকে সন্তানধারণের সময়, আদৌ সন্তান নেবেন কি না, ক’জন সন্তান নেবেন ও প্রয়োজনে নিরাপদে ও আইনি পথে গর্ভপাত করানোর অধিকার দেওয়া হয়েছে।’ এর পাশাপাশি এ-ও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়, প্রতিটি মেয়ে বা মহিলার যে সাম্য ও গোপনীয়তার মৌলিক অধিকার রয়েছে তার মূলে আছে প্রজননের ক্ষেত্রে তাঁর একান্ত নিজস্ব সিদ্ধান্ত।
‘মেডিক্যাল টার্মিনেশন অফ প্রেগন্যান্সি’ (MTP)-র ৩(২) ধারায় বলা আছে, গর্ভাবস্থা কন্টিনিউ করলে যদি অন্তঃসত্ত্বার মারাত্মক শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সে ক্ষেত্রে গর্ভপাত করানো যাবে।’ এর বিস্তারিত ব্যাখ্যায় বিচারপতি বলেন, ‘৩(২) ধারার এক্সপ্ল্যানেশন ২ বলছে, প্রেগন্যান্সি যদি ধর্ষণের ফলে হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে মনে করা হয় তা মহিলার মনে ও শরীরে ভয়াবহ ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। ফলে ধর্ষণের শিকার কোনও মহিলাকে ধর্ষকের সন্তান জন্ম দেওয়ায় বাধ্য করা যায় না। সেই নির্যাতিতাকে গর্ভপাত করতে না দেওয়ার অর্থ তার উপরে জোর করে মাতৃত্বের দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে তাঁর মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়।’
এই মামলার ক্ষেত্রে মেয়েটিকে ধর্ষণের অভিযোগ আছে তার ‘প্রেমিকের’ বিরুদ্ধে। MTP Act-এ যদিও বলা হয়েছে, ২৪ সপ্তাহের পরে আর গর্ভপাত করানো যাবে না। কিন্তু সংবিধানের ২২৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্টের অধিকার আছে বিশেষ ক্ষেত্রে মেডিক্যাল বোর্ডের পরামর্শ নিয়ে অন্তঃসত্ত্বাকে গর্ভপাতে অনুমতি দেওয়ার। সেই অধিকার প্রয়োগ করে ও মেডিক্যাল বোর্ডের পরামর্শ নিয়ে কেরালা হাইকোর্ট এ দিন মেয়েটিকে গর্ভপাতের অনুমতি দেয়। মেডিক্যাল বোর্ড যে রিপোর্ট কোর্টকে জমা দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে ‘অন্তঃসত্ত্বা নাবালিকা যদি সন্তানের জন্ম দেয় তা হলে তার ভয়াবহ মানসিক ক্ষতের সৃষ্টি হবে যে হেতু সে ধর্ষণেক ফলে গর্ভধারণ করেছে।’ তার পরেই মেয়েটির পক্ষে রায় দেয় কোর্ট।
বহু ক্ষেত্রেই এখন দেখা যাচ্ছে, অ্যাডভান্সড প্রেগন্যান্সি স্টেজে অনেক নির্যাতিতাই গর্ভপাতের অনুমতি চেয়ে শীর্ষ আদালত-সহ নানা কোর্টের দ্বারস্থ হচ্ছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা দেওয়া হচ্ছে না। ফলত, সেই অন্তঃসত্ত্বারা যখন সন্তানের জন্ম দিতে বাধ্য হচ্ছে, তা তাদের মনে চিরকালীন ক্ষত তৈরি করছে। তারা স্বাভাবিক ভাবে জীবনধারণের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বছর দু’য়েক আগে ১২ বছরের ধর্ষিতা অন্তঃসত্ত্বাকে গর্ভপাতের অধিকার দেয়নি গুজরাট হাইকোর্ট। মেয়েটি তার ফলে ‘লজ্জায়’ আত্মহত্যা করে।
তাই এ দিনের কেরালা হাইকোর্টের রায় খুব স্পষ্ট ভাবেই একটি দিক নির্দেশ করছে — তা হলো ভ্রূণের জীবনের অধিকার এই সব সেক্সুয়াল ক্রাইমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। যদি গর্ভপাতের সময় দেখা যায় যে আসলে প্রিম্যাচিওর ডেলিভারি করাতে হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে সদ্যোজাতকে নিও-নেটাল কেয়ারে রেখে তার যত্ন করতে হবে। সে দায়িত্ব রাষ্ট্রের। অনেক আইনি বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, কেরালা হাইকোর্টের এই ব্যাখ্যা অত্যন্ত সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয়। এর ফলে অনেক নির্যাতিতা হয়তো আদালতের দ্বারস্থ হতে সাহস পাবে।