Lok Sabha Election : ভয়াবহ গরমে কি নির্বাচনের সময় বদলাবে
এই সময় | ০৮ মে ২০২৪
কুবলয় বন্দ্যোপাধ্যায়
নিছক ভোট নয়, ‘গণতন্ত্রের উৎসব’। সারা পৃথিবীতে ভারতের লোকসভা নির্বাচনের পরিচিতি এমনই। বিস্তৃত মাঠের মাঝে একটা স্কুলবাড়ি, আর তারই সামনে ভোটাধিকার প্রয়োগের অপেক্ষায় কয়েকশো মানুষ। আকাশের কড়া রোদ থেকে বাঁচতে ওঁদের মাথায়, মুখে গামছা জড়ানো। দেশে ভোট বলতেই মানসপটে যেন এমনই একটা ছবি ভেসে ওঠে। ‘ভোটের ছবি’ হিসেবে পরিচিত এই দৃশ্য কি বদলাতে চলেছে।গামছার বদলে কি আগামী দিনে মাফলারে কান ঢাকা লোকজনের লাইন দেখা যাবে? চরম আবহাওয়ার দৌলতে আগামী দিনে কি ভোটযজ্ঞের সময় গরমকাল থেকে সরিয়ে নিয়ে বাধ্য হবেন দেশের নীতি-নির্ধারকেরা? পরিবেশবিদদের দাখিল করা তথ্য হয়তো ওঁদের নতুন কিছু ভাবতে বাধ্য করবে শিগগিরই।
সংখ্যাটা আর চার, আট বা দশ দিনে আটকে নেই। এপ্রিল থেকে মে-র শুরু পর্যন্ত গোটা দেশ টানা ২৪ দিন তাপপ্রবাহে ঝলসেছে। কয়েক বছর আগেও যেখানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পার করলেই হইহই পড়ে যেত, এখন সেখানে ৪০ না হলেই অবাক হন অনেকে। দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা তো ৪৭ ডিগ্রির ঘরও পার করে ফেলে অক্লেশে।
২০১৫-র এল নিনোর দৌলতে এখনও পর্যন্ত ২০১৬ সালকে মানব ইতিহাসের উষ্ণতম বছর হিসেবে উল্লেখ করছেন আবহবিদরা। কিন্তু ওই তকমা ২০২৪-এর দখলে চলে যাওয়ার আশঙ্কা নাকি ৯৯ শতাংশ। বছরের প্রথম চার মাস কাটানোর পরেই এমন সিদ্ধান্ত আবহবিদদের। চিকিৎসকরা মনে করেন, দীর্ঘক্ষণ ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় থাকা মানুষের স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। কিন্তু এবছর এপ্রিলে? দেশের সবচেয়ে জনবহুল অন্তত ১৮টি শহরের তাপমাত্রা টানা ৪০ ডিগ্রির ওপরে ছিল।
আর এমনই ভয়াবহ আবহাওয়ায় শুরু হয়েছে দেশের ভোটপর্ব। ১৯ এপ্রিল থেকে ১ জুন— ভারতীয় উপমহাদেশ যে সময়ে উষ্ণতম, সেই সময়েই ৯০ কোটির বেশি মানুষ তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করছেন। মার্চ ও এপ্রিলে ঝড়-বৃষ্টি, কালবৈশাখীর অভাবেই যে এবার দেশজুড়ে তাপপ্রবাহের এমন বাড়বাড়ন্ত সে কথা স্বীকার করেছেন আবহবিদরা। একই সঙ্গে তাঁদের তথ্য বলছে, গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে মার্চ ও এপ্রিলে ঝড়বৃষ্টির প্রবণতা কমছে। সুতরাং আগামী বছরগুলিতেও মার্চ এপ্রিলের আবহাওয়া যে মোলায়েম থাকবে এমন আশায় না থাকারই পরামর্শ আবহবিদদের। তা হলে দেশের সাধারণ নির্বাচনের সময়ে কি পরিবর্তন আনা আবশ্যিক?
কেন গরমকালকেই নির্বাচনের জন্য বেছে নেওয়া হয়? এর সম্ভাব্য কারণ একাধিক। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপকরা জানাচ্ছেন, নির্বাচন প্রক্রিয়া গরমে হলে হাজার হাজার ভোটকর্মীর পক্ষে ভোট কেন্দ্রে থাকা অনেক সহজ হয়। এছাড়াও, বছরের এই সময়টা কৃষিকাজের চাপ তুলনায় কম থাকে। কাজেই কৃষিপ্রধান দেশে সবচেয়ে বেশি মানুষকে ভোটে সামিল করার এটাই প্রশস্ত সময়। কিন্তু আবহাওয়া যে ভাবে চরম ভাবাপন্ন হয়ে উঠছে তাতে কড়া রোদের নীচে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা আর ভোটারদের জন্য নিরাপদ নয়। এবছরই কেরালায় ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
ইতিমধ্যেই ভারতের নির্বাচন কমিশন ভোটারদের ওপরে তাপপ্রবাহের প্রভাব মোকাবিলায় একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করেছে। এই দলে নির্বাচন কমিশনের কর্মীরা ছাড়াও মৌসম ভবন, জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা দল, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের আধিকারিকরা রয়েছেন। আবহাওয়ার প্রভাবে নির্বাচনের সময় এগিয়ে বা পিছিয়ে আনা প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে দেশের প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ও পি রাওয়াত বলছেন, ‘লোকসভা নির্বাচনের জন্য ছ’মাসের একটা টাইম উইন্ডো থাকে। রাজনৈতিক দলগুলো তো নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সুবিধামতো সময় নির্বাচন করতে পারে। মানুষ যদি ভোট দিতেই না পারেন, তা হলে ভোটের কী অর্থ?’
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং ভারতীয় সংবিধান বিশেষজ্ঞ উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিষয়ে বলছেন, ‘নির্বাচন যে গরমকালেই করতে হবে এমন কোনও শর্ত নেই। ১৯৫১ সালে প্রথম যে নির্বাচন হয়েছিল, সেটাই ডিসেম্বর মাসে শুরু হয়েছিল। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী মারা যাওয়ার পর নির্বাচন হয়েছিল নভেম্বর-ডিসেম্বর নাগাদ। আমার মনে হয়, নির্বাচনের জন্য ফেব্রুয়ারি সবচেয়ে ভালো সময়।’ অধ্যাপক বলছেন, ‘আসলে লোকসভার সময়সীমা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। নির্বাচন এপ্রিলের বদলে ফেব্রুয়ারিতে এগিয়ে আনতে গেলে অন্তত একবার তো কেন্দ্রের সরকারকে নির্দিষ্ট সময়ের আগে অব্যাহতি নিয়ে ভোট করার প্রস্তাব আনতে হবে। সেটা করবে কে?’
আবহাওয়ার গত কয়েক বছরের প্রবণতা দেখে এখনই এমন কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে অবশ্য মনে করছেন না কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পার্থিব বসু। তিনি বেশ কয়েক বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশের ওপর তার প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছেন। পার্থিববাবু বলেন, ‘গত ৩০ বছরে কলকাতার ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি গরম হয়েছে। আবহাওয়া যে চরম হয়ে পড়ছে সে বিষয়ে বিতর্ক নেই। তবে, নির্বাচনের মতো গুরুতর একটা বিষয়ের সময়সূচি বদলে ফেলার প্রয়োজন এখনই হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। আরও কয়েক বছর পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে।’