• আমার মনকেমনের চিরকালের মৌ
    আজকাল | ০৮ মে ২০২৪
  • রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়:‌ ‘‌আমি মরে গেলে তুমি কিন্তু কিছু লিখবে রঞ্জনদা’‌, এই কথাটা মৌ বেশ কয়েকবার বলেছে আমাকে। এবং ‘‌এটা কোনও কথা হল মৌ!‌’‌, বা এরকম কিছু হালকা কৌতুকী কথার আড়াল টেনে আমি সরে গেছি, এড়িয়ে গেছি। সত্যি কোনও দিন ভাবতে পারিনি আমি তিরাশি বছর বেঁচে থাকব, পৌঁছোব ৭ মে ২০২৪–‌এ, যেদিন সকালবেলা আমি পাব আমার আদ্দেক বয়সের মৌ রায়চৌধুরীর মৃত্যুসংবাদ এবং যেদিন সেই মেয়ের আদেশ, ‘‌আমি মরে গেলে তুমি কিন্তু কিছু লিখবে রঞ্জনদা’‌ আমার ওপর সত্যিই নেমে আসবে গ্রিক ট্র‌্যাজেডির নিয়তি–নির্ধারিত অরেকল্‌ বা দৈবাদেশের অনিবার্যতায়। এবং ধারণ করবে সেই অরেকল্‌ গ্রিক ট্র‌্যাজেডির আয়রনি, বা অব্যর্থ ব্যাজোক্তি!‌ কে জানত আমার লেখা মৌয়ের ‘‌অবিচুয়ারি’‌ প্রকাশিত হবে ২৫ বৈশাখ, মৌয়ের সবথেকে ভালবাসার মানুষ, তার পুরুষোত্তমের জন্মদিনে!‌লাতিন ‘‌অবিচুয়ারি’‌ শব্দটি, যার আক্ষরিক অর্থ শোকসংবাদ, আমার মোটেও পছন্দ নয়। অবশ্য আমি জানি না ‘‌চুয়ারি’‌ শব্দটির সঙ্গে সংস্কৃত ‘‌চারণ’‌ শব্দটির আদৌ কোনও সম্পর্ক আছে কি নেই। মৌ কিন্তু আমার বাকি জীবনে বেঁচে থাকল আমার মনকেমনের চারণভূমি হয়ে। আমার শেষ দেখা মৌ তার অন্তিম অনন্ত নিদ্রায়। মৃত্যু তাকে জড়িয়ে আছে লাল বেনারসি হয়ে। মৃত্যু তার সারা শরীর জুড়ে রজনীগন্ধার বাগান। তার দুধে–‌আলতা করতল দুটি বেনারসির স্রোত আর রজনীগন্ধার বিততির ওপর মধুর মায়ায় ন্যস্ত!‌আর কি কখনও কেউ বাড়িতে মাগুর মাছের ঝোল হলেই বলবে, আজ রাত্তিরে আমার বাড়িতে খাবে!‌ তোমার পছন্দের মাগুর মাছের ঝোলভাত। কিংবা ডিমভরা সরষে–‌ট্যাংরা। মৌ তার রান্নায় নিয়ে আসত মর্মী ম্যাজিক। তার রান্নার সেই শৌভিকতা মিশে থাকল আমার মউল–‌মনকেমনে। মৌ একেবারে দেখতে পারত না আমার হুইস্কিপ্রেম। কিন্তু নিজে হাতে ভেজে দিত সেই ছাইপাঁশের সঙ্গে ভেটকির ফ্রাই। এবং ফ্রাইয়ের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে ভুলত না ছাইপাঁশ গেলার বকুনি। এই সব কিছু হয়ে রইল বাকি জীবন আমার মনকেমন ও বেদনার গয়না। এইসব স্মৃতি আমি না খুঁড়ে পারব না, বেদনার মাধুর্যে মৌকে ফিরে–‌ফিরে পেতে!‌মৌ আর সত্যমের শান্তিনিকেতনের স্নিগ্ধ আবাসে বেশ কয়েকদিন কাটিয়েছিলাম একবার। আর কোনও কিছু উপলক্ষে নয়, শুধু তিনজনে একসঙ্গে হব বলে। সত্যম, মৌ, আমি— আমরা তিনজনেই রবীন্দ্রনাথকে ভালবাসি, এইটে হয়তো আপাতভাবে একটা মিলের দিক। কিন্তু মৌয়ের রবীন্দ্রপ্রেম ছিল সমস্ত মনপ্রাণ উজাড় সংশয়হীন সমর্পণ!‌ রবীন্দ্রনাথের জন্য এইরকম প্রাণঢালা ভালবাসা আমি বাঙালির রবীন্দ্রন্যাকামি বা ভাবালুতার মধ্যে বিশেষ পাইনি। মৌয়ের শান্তিনিকেতনের বাড়িতে আমি দেখেছি, মৌ রবীন্দ্রনাথের নিত্য আরাধনায় কতক্ষণ নিবিড় সময় কাটায়। আর দেখেছি জীবনের গভীর দুঃখে, কিংবা হতাশায়, কিংবা বিশুদ্ধ আনন্দে–‌অনুরাগে রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখতে। যেন এক অদৃশ্য প্রাণেশকে জানানো প্রেম ও প্রণতি একসঙ্গে, প্রতিটি পত্র!‌ কখনও চোখের জল ঝরেছে সেই পত্রের গায়ে, এমনও দেখেছি।মৌ ছিল গভীরভাবে ভগবানে বিশ্বাসী। এবং শ্রীকৃষ্ণ বলতে অজ্ঞান। আমি চিরকালের সংশয়ী এবং বেশ তির্যক, কৃষ্ণভক্ত মৌকে কিছুটা নাস্তিকবাদে দীক্ষিত করতে চেয়ে মহা বেকায়দায় পড়েছি বারবার। মৌয়ের ভক্তিতে, বিশ্বাসে, প্রাণাঞ্জলিতে এতটুকু চিড় ধরাতে পারিনি। মৌয়ের সরল প্রত্যয় আমাকে বারবার গোহারান হারিয়েছে!‌ সেই মৌ প্রতি জন্মাষ্টমীর রাত্রে নেমন্তন্ন করত আমাকে। কিন্তু আমার তো প্রসাদের সঙ্গে হুইস্কি চাই। মৌ সেই ‘‌স্পেশ্যাল’‌ ব্যবস্থাও রাখত আমার জন্য। এমনই ছিল মৌয়ের মায়া, মমতা, স্নেহ, ভালবাসা!‌ প্রসাদের সঙ্গে হুইস্কি মেশাচ্ছি আর মৌ তাকিয়ে দেখছে— মৌয়ের সেই দৃষ্টিও বাকি জীবন তাকাবে আমার পানে, আমার মনকেমনের চারণভূমিতে।মৌয়ের সঙ্গে আমার শেষ দেখা ১৫ এপ্রিল। সকাল থেকে প্রায় বিকেল পর্যন্ত একসঙ্গে ছিলাম এক অনুষ্ঠানে। খাওয়াদাওয়া, গল্প, আড্ডা। থাইল্যান্ডের পেয়ারা খেলাম দু’‌জনে। বুঝতে পারছিলাম শরীরটা মৌয়ের খুব ভাল যাচ্ছে না। কিন্তু মৌকে দেখলাম, সত্যমের পরিশ্রম ও শরীর নিয়েই যেন বেশি চিন্তিত। কে জানত তখন, ওর নিজের জীবনের আর মাত্র বিশ–‌বাইশ দিন বাকি!‌মৃত্যু যে মৌয়ের এত কাছাকাছি এসে অপেক্ষমাণ, বিন্দুমাত্র টের পাইনি ১৫ এপ্রিল। ৭ মে ভোরবেলা খবরটা পেলাম। কেমন যেন দিশাহারা মনে হল নিজেকে। একরাশ কান্না এল ভেতর থেকে— বেদনা যেন ছিটকে বেরিয়ে এল চোখের জল হয়ে। মাত্র একজনকেই আমার এই কষ্ট হোয়াটসঅ্যাপে জানালাম। আমার বস্‌, প্রতিদিনের সম্পাদক, টুম্পাই (‌সৃঞ্জয় বোস)‌–‌কে। মুহূর্তে এল টুম্পাইয়ের সাড়া:‌ ‘‌ভেরি শকিং। ওয়াজ আ ভেরি গুড সোল।’‌ মৌ এর প্রসঙ্গে এর চেয়ে সত্যি কথা আর কী হতে পারে!
  • Link to this news (আজকাল)