• হিন্দু ‘কমার’ আচমকা রিপোর্টের মূলে শাসক-স্বার্থ?
    এই সময় | ১০ মে ২০২৪
  • এই সময়: লোকসভা ভোট যখন মাঝ-পর্বে, প্রচারে যখন শাসক বিজেপি ক্রমাগত মেরুকরণ উসকে দিচ্ছে, ঠিক সেই সময়েই প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের একটি ‘ওয়ার্কিং পেপার’ আচমকা সামনে এলো। যেখানে দাবি করা হয়েছে, ১৯৫০ থেকে ২০১৫-র মধ্যে ভারতে মোট জনসংখ্যায় হিন্দুর হার যেখানে ৭.৮২ শতাংশ কমেছে, সেখানে মুসলিম সম্প্রদায়ের হার বেড়েছে ৪৩.১৫ শতাংশ।‘শেয়ার অফ রিলিজিয়াস মাইনরিটিজ: এ ক্রস-কান্ট্রি অ্যানালিসিস (১৯৫০-২০১৫)’ শীর্ষক পেপারে প্রধান দুই ধর্ম-সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা-হারের এই প্রবণতাকে ভারতে বৈচিত্র্যপূর্ণ সহাবস্থানের নজির হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই একে বিজেপির মেরুকরণ রাজনীতির সমর্থনে তৈরি নথি হিসেবে দেখছেন। তাঁদের বক্তব্য, পরিসংখ্যান পরিবেশনের ধরনেই লুকিয়ে অভিসন্ধি।

    বিজেপি-সহ সঙ্ঘ পরিবার মুসলিম সংখ্যাবৃদ্ধি নিয়ে মিথ্যাচারের মাধ্যমে যে মেরুকরণের রাজনীতি চালিয়ে আসছে আগাগোড়া, সেই রাজনীতির পালে হাওয়া জোগাতেই বিকৃত তথ্যের এই পেপার বলে মনে করছেন বিরোধীরাও। ২০১১-র পর জনগণনা না-হওয়া সত্ত্বেও ধর্ম-পরিচয়ের ভিত্তিতে জনসংখ্যার পরিসংখ্যান প্রকাশের নৈতিকতা, জনসংখ্যা-বৃদ্ধির তুলনামূলক হার বেমালুম গোপন করে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাসের তুলনায় মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি কমছে বলেই ২০১১-র সেন্সাস রিপোর্ট জানিয়েছিল।

    এই পেপার প্রকাশ্যে আনার সময় নির্বাচনকে গেরুয়া-শিবিরের ভোট-প্রচার কৌশলের পরিপূরক বলে মনে করছেন বিরোধীরা। যে ভাবে পরের পর সভায় নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, যোগী আদিত্যনাথরা সংখ্যালঘু মুসলিমদের আক্রমণ শানাচ্ছেন, এই পেপারের বিকৃত তথ্যও অচিরে তাঁরা ভোট-প্রচারে ব্যবহার করবেন বলে অনুমান বিরোধীদের। সেই সঙ্গেই সংখ্যালঘু-প্রশ্নে মোদী সরকারের ভূমিকা, দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের বারংবার তোলা অস্বস্তিকর প্রশ্নের জবাব হিসেবেও সরকার এই পেপারকে ঢাল করতে পারে বলে অনুমান অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের।

    প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য শমিকা রবির নেতৃত্বাধীন টিমের তৈরি পেপারে দাবি করা হয়েছে, ১৯৫০-এ দেশের মোট জনসংখ্যার ৮৪.৬৮% ছিল হিন্দুরা, ২০১৫-য় তা দাঁড়িয়েছে ৭৮.০৬%। একই সময়ে মুসলিমদের হার ৯.৮৪% থেকে বেড়ে হয়েছে ১৪.০৯%। খ্রিস্টানদের ক্ষেত্রে ২.২৪% থেকে ২.৩৬%। শিখদের ক্ষেত্রে ১.২৪% থেকে ১.৮৫%। অন্য দিকে পার্সিরা মোট জনসংখ্যার ০.০৩% থেকে কমে হয়েছে ০.০০৪%। জৈনরা ০.৪৫% থেকে কমে ০.৩৬%।

    পেপারে দাবি করা হয়েছে, সংখ্যাগুরুর কমা এবং সংখ্যালঘুর বাড়া এ দেশে সরকারি, রাজনৈতিক, সামাজিক প্রক্রিয়ার সদর্থক পরিণতিরই সূচক, যা বৈচিত্র্যকে ধারণে সক্ষম। পেপারে অবশ্য এটাও স্বীকার করা হয়েছে, গোটা বিশ্বে সব দেশেই ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর আপাত-সংখ্যা হ্রাসের সঙ্গে ভারতের প্রবণতা সামঞ্জস্যপূর্ণ। পেপারে এ তথ্যও রয়েছে যে, ১৬৭টি দেশের পরিসংখ্যান-বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ১৯৫০-এ সব দেশ মিলিয়ে ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর গড় হার ছিল মোট জনসংখ্যার শতকরা ৭৫ ভাগ (ভারতে ঢের বেশি, ৮৪.৬৮%)। ২০১৫ অবধি ৬৫ বছরে এ ক্ষেত্রে পরিবর্তনের (কমার) গড় হার ২১.৯% (ভারতে সামান্যই, মোটে ৭.৮২%)।

    তবে দক্ষিণ এশিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, আফগানিস্থানে সংখ্যাগুরুর বৃদ্ধি এবং সংখ্যালঘু হ্রাসের কথাও বলা হয়েছে। সে তুলনায় ভারতের প্রবণতাকে ইতিবাচক বলে তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ থেকে সেখানকার সংখ্যালঘুদের ক্রমাগত ভারতে আসারও উল্লেখ রয়েছে। এখানেই না-থেমে মালদ্বীপ ছাড়া সব মুসলিম-প্রধান দেশে সংখ্যাগুরু (মুসলিম) জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে।

    সার্বিক ভাবেই এ জাতীয় তথ্য পরিবেশনের ধরন, উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ২০১১-র পর ভারতে জনগণনা না-হওয়া সত্ত্বেও এ রকম তথ্য-পরিসংখ্যান কতদূর ঠিক--সে প্রশ্ন উঠেছে। ধর্ম-ভিত্তিক এই পরিসংখ্যান কেন, দারিদ্র, বেকারত্বের মতো বিষয় নিয়ে নয় কেন--বিশেষত যেখানে পেপারটি তৈরি করেছে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টামণ্ডলী--সে প্রশ্নও উঠেছে। মুসলিমদের নিয়ে চর্চায় গুরুত্ব আরোপে শাসকদলের অ্যাজেন্ডার ছাপই স্পষ্ট বলে মনে করছেন বিরোধীরা।

    জনসংখ্যা-বিশেষজ্ঞরা এই পেপারের সব থেকে মারাত্মক খামতি বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত চেপে যাওয়া হিসেবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনামূলক তথ্য না-থাকাকে চিহ্নিত করছেন। তাঁদের বক্তব্য, ২০১১-র সর্বশেষ সেন্সাস রিপোর্ট জানাচ্ছে, ১৯৯১-২০০১, এই এক দশকে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ২৯.৫২%। পরের দশকে তা আসলে ৫% কমে হয়েছে ২৪.৬%। হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে সেখানে মাত্রই ৩%। অর্থাৎ, মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আসলে কমছে।

    এই সত্য গোপন করে ভোটের মধ্যে পেপার প্রকাশ মোদী সরকারের আর একটা ‘জুমলা’ বলে চিহ্নিত করেছেন বিরোধীরা। সিপিএম পলিটব্যুরোর সদস্য এবং দলের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য, ‘দেশের ক্ষমতাসীন দলের অ্যাজেন্ডা অনুসারে কাজ করা প্রধানমন্ত্রীর কিছু উপদেষ্টা এই ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশের বদলে জনসংখ্যার প্রকৃত তথ্য প্রকাশে বরং সঠিক সেন্সাসের ব্যবস্থা করুন। ২০২১-এর সেন্সাস তো ২০২৪-এও হলো না! নির্বাচন চলাকালীন এই পেপার প্রকাশ বিজেপি-আরএসএসের অ্যাজেন্ডা মেনেই।’

    সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির সদস্য শুভঙ্কর সরকার বলেন, ‘আমি পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাপটে বলতে পারি। ২০১১-র সর্বশেষ সেন্সাস অনুসারে, পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু জনসংখ্যার বৃদ্ধি মুসলিমদের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের উচিত ক্ষুধাসূচক এবং বেকারত্বের মতো জ্বলন্ত সমস্যাগুলিতে মনোনিবেশ করা।’ তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভা সদস্য সামিরুল ইসলামের মন্তব্য, ‘ভোটের মাঝে প্রকাশিত এই প্রতিবেদন থেকে বোঝা যায় যে পরাজয়ের ভয় বিজেপিকে কী ভাবে গ্রাস করছে।’
  • Link to this news (এই সময়)