• দেশে মেয়েদের অবস্থান ঠিক কোথায়
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ১৫ মে ২০২৪
  • প্রবীর মজুমদার
    পৃথিবীর সব থেকে বড় গণতান্ত্রিক দেশের ভোট মানে সাজো সাজো রব৷ শুধু দেশের নয়, বিদেশের সংবাদমাধ্যমও এখন ভারতবর্ষের রাজনীতি নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করছে৷ তবে এবারের মত আগের কোনো নির্বাচনে ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের মত অভিযোগ অন্যতম মুখ্য আলোচিত বিষয় হয়ে ওঠেনি৷ এরই মধ্যে প্রোজ্জ্বল রেবন্ন, যিনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌড়ার নাতি, কর্ণাটকে হাসান কেন্দ্রে জেডিএস দলের সাংসদ এবং এবারের লোকসভা নির্বাচনেও প্রার্থী, প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং যাঁর হয়ে প্রচার করেছেন, তিনি শিরোনামে উঠে এসেছেন৷ কারণ তিনি কয়েকশো মহিলাকে যৌন নির্যাতন করে হাজার দুয়েক ভিডিও বানিয়েছেন বেশ কয়েকবছর ধরে৷ সেইসব ভিডিও ছডি়য়ে পড়ায় কর্ণাটক পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করেছে, গ্রেফতার করার জন্যে খুঁজছে, প্রোজ্জ্বল দল থেকে বহিষ্কৃত৷ তার আগেই অবশ্য তিনি দেশ ছেডে় পালিয়ে গেছেন৷
    কোন দলের সহায়তায় পালিয়েছেন, কেন তাঁর দল এবং জোটসঙ্গী বিজেপি সব জেনেও তাঁকে সমর্থন জানিয়েছে, কেন জাতীয় মহিলা কমিশন প্রথম দিকে চুপচাপ ছিল ? সবকিছু নিয়েই প্রশ্ন উঠছে, ওঠা স্বাভাবিক৷ কিন্ত্ত প্রোজ্জ্বলের যত কুকীর্তির অভিযোগ প্রকাশিত হচ্ছে তত মনে হচ্ছে, আমরা সমাজ হিসাবেই নারী নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছি৷
    নারীদের উপর যৌন অত্যাচার চালানো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সংখ্যা কম নয়৷ খুব কম ক্ষেত্রেই দেখা গেছে তারা কোনোরকম শাস্তি ভোগ করেছে৷ ভারতবর্ষে সাম্প্রতিককালে আমরা সকলেই ব্রিজভূষণ সিংয়ের কুস্তিগীরদের যৌন হেনস্থা করার কথা জেনেছি৷ তাঁকে এবার লোকসভার টিকিট দেওয়া হয়নি, তার বদলে দেওয়া হয়েছে তাঁর পুত্রকে৷ পিতৃতান্ত্রিক ভোটব্যবস্থার এমন নজির আমরা অনবরত দেখছি৷ এমনকি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের বিরুদ্ধেও শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠেছে, কিন্ত্ত ওই পদের সাংবিধানিক রক্ষাকবচ থাকায় কোনোরকম তদন্ত সম্ভব হচ্ছে না৷ পশ্চিমবঙ্গের সন্দেশখালিতে দিনের পর দিন তৃণমূল কংগ্রেসের পার্টি অফিসে মহিলাদের ডেকে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে এর আগেই অভিযোগ উঠেছিল৷ নির্বাচন পর্বে তা নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে৷ এখন আবার অভিযোগ উঠছে, তেমন কিছু নাকি আদৌ ঘটেনি৷ সবটাই বিজেপির চক্রান্ত৷
    ৪ মে?র পর ১১ মে৷ এক সপ্তাহের ব্যবধানে ফের প্রকাশ্যে সন্দেশখালির বিজেপি নেতা গঙ্গাধর কয়ালের দ্বিতীয় ভিডিও৷ ৪৬ মিনিট ৭ সেকেন্ডের স্টিং অপারেশনের ওই ভিডিওয়র শুরুতেই বিজেপি নেতা গঙ্গাধরকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘সন্দেশখালিতে নারী নির্যাতনের প্লট সাজানো! ৭২ জন মহিলাকে ২ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছিল!’
    শনিবার রাতেই কলকাতায় এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ রবিবার রাজ্যের চারটি এলাকায় নির্বাচনী সভা করেছেন৷ তার মাঝেই সন্দেশখালি কাণ্ডে বিজেপি নেতার দ্বিতীয় ভিডিও ঘিরে ফের সরগরম রাজ্য রাজনীতি৷ ৪ মে গঙ্গাধরের প্রথম ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল৷ যেখানে গঙ্গাধরকে বলতে শোনা গিয়েছিল, সন্দেশখালিতে রেখা পাত্রদের ধর্ষণের অভিযোগ সাজানো৷ তাঁদের ব্রেন ওয়াশ করা হয়েছে৷ সেই সঙ্গে তাঁর দাবি, এজন্য বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী তাঁদের টাকা ও মোবাইল দিয়ে সাহায্য করেছিলেন৷ গঙ্গাধরের ওই ভিডিও সামনে আসার পর নির্যাতিতাদের একাধিক ভিডিও ভাইরাল হয়৷ যেখানে মহিলাদের বলতে শোনা গিয়েছে, সাদা কাগজে সই করিয়ে পরে তাতে ধর্ষণের অভিযোগ লেখানো হয়েছিল৷
    ফের ১১ মে অর্থাৎ শনিবার রাতে ভাইরাল হওয়া স্টিং অপারেশনের ভিডিওয় সন্দেশখালির বিজেপি নেতা গঙ্গাধরকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ?আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে ‘অর্থ’ ও ‘অস্ত্র’-দু’য়েরই প্রয়োজন রয়েছে! আপাতত আমার চলার জন্য এক লক্ষ টাকা লাগবে৷ সঙ্গীদের মোটরবাইকে তেল ভরার ব্যবস্থাও করতে হবে৷ মদের জন্য ৫০টি বুথে ৫ হাজার টাকা করে দিতে হবে৷ প্রয়োজন ৫০টি পিস্তলও৷’
    সোমবার চতুর্থ দফায় রাজ্যের আটটি কেন্দ্রে ভোট৷ তার আগে বিজেপি নেতার এহেন বয়ান সামনে আসায় স্বাভাবিকভাবে রাজ্য রাজনীতিতে ফের শোরগোল তৈরি হয়েছে৷ যদিও বিজেপির পাশাপাশি গঙ্গাধরও ভাইরাল হওয়া ভিডিওকে ?ফেক? বলে দাবি করে ইতিমধ্যে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন৷ চেয়েছেন সিবিআই তদন্তও৷ রবিবারের সভা থেকে মোদী এব্যাপারে কিছু বলেননি৷
    টাকার বিনিময়ে পরিকল্পিত ভাবে সন্দেশখালিতে নারী নির্যাতনের গল্প সাজিয়েছিল বিজেপি, ‘সন্দেশখালি স্টিং অপরেশনের প্রথম ভিডিও প্রকাশ্যে আসতেই এমন অভিযোগ তোলা হয়েছিল শাসক দলের তরফে৷ এরই মাঝে প্রকাশ্যে এল সন্দেশখালি স্টিং অপরেশনের দ্বিতীয় ভিডিও৷ যেখানে সন্দেশখালি ২ ব্লকে বিজেপির মণ্ডল সভাপতি সেই গঙ্গাধর কয়ালকেই বলতে শোনা যাচ্ছে, আন্দোলন করানোর জন্য এখনও পর্যন্ত ৭২ জন মহিলাকে টাকা দেওয়া হয়েছে৷ বহু আন্দোলনকারীকে দেওয়া হয়েছে মোবাইল ফোন৷ সন্দেশখালির পর আন্দোলনের আঁচ এসে পড়ে জেলিয়াখালি, বেড়মুজুরে৷ সেখানেও মহিলাদের ৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছিল বলে দাবি গঙ্গাধরের৷ ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে বিজেপির এক স্থানীয় নেতা তেমনটাই বলছেন৷ ভিডিওর সত্যাসত্য যা-ই হোক, মেয়েদের সম্মানকে যে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে সব পক্ষই, তাতে সন্দেহ নেই৷
    নির্বাচনে কোন দল জয়ী হবে তা নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে৷ ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, এবারের নির্বাচনে বোধ হয় পুরুষতন্ত্র এখনই জিতে গেছে৷ যে কারণে মেয়েদের মঙ্গলসূত্র বড় খবর হয়ে ওঠে আর কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী তাঁর বক্তব্যে মেয়েদের নিজের পরিবারে অবৈতনিক শ্রমের কথা উল্লেখ করলেও প্রায় কোনো কাগজেই সে খবর দেখতে পাওয়া যায় না, ঠিক সেই কারণেই প্রোজ্জ্বলের ধর্ষণের ঘটনা আলোচিত হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণা থেকে৷ সোশাল মিডিয়ায় প্রকাশিত মতগুলো একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, মেয়েদের আমাদের দেশের মানুষ কী চোখে দেখছে৷
    এবছর নির্বাচনের এক বহু আলোচিত বিষয় হল, বিজেপি ভোটে জিতলে সংবিধান বদলে দেবে৷ এখানে মনে রাখা দরকার, ভারতের সংবিধানে প্রথম থেকেই নারী, পুরুষকে সমানাধিকার দেওয়া হয়েছে৷ যে কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে যেমন স্পষ্ট হয় পরিবারে নারী-পুরুষের ভূমিকা, তেমন এই ভোট উৎসবেও কিন্ত্ত বোঝা যাচ্ছে দেশে মেয়েদের অবস্থান ঠিক কোথায়৷ হয়ত প্রোজ্জ্বলকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে, হয়ত তাকে শাস্তিও দেওয়া হবে৷ কিন্ত্ত মেয়েদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করার কাজ এদেশে কে দায়িত্ব নিয়ে করবে ? সে প্রশ্ন এই নির্বাচন আবার আমাদের সামনে এনে দিল৷
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)