‘নতুন বুয়া’ বলে আক্রমণ মোদীর, উত্তরপ্রদেশে নিশানায় তৃণমূল
আনন্দবাজার | ১৭ মে ২০২৪
বাংলার রাজনৈতিক তরজাকে উত্তরপ্রদেশের জনসভার মঞ্চে টেনে আনলেন নরেন্দ্র মোদী। যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যে আজ কার্যত নজিরবিহীন আক্রমণে প্রধানমন্ত্রী বিঁধলেন তৃণমূল কংগ্রেসকে। এমনকি অখিলেশ যাদব বাংলা থেকে ‘নতুন পিসি’ (বুয়া) নিয়ে এসেছেন বলেও কটাক্ষ ছুড়ে দিলেন। বিরোধীদের মতে, নাম না করলেও মোদী বুঝিয়ে দিয়েছেন, তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই তাঁর নিশানা।
উত্তরপ্রদেশের ভদোহী থেকে ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের হয়ে লড়ছেন তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী তথা রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কমলাপতি ত্রিপাঠীর বংশধর ললিতেশপতি ত্রিপাঠী। আজ সেই কেন্দ্রে গিয়ে ললিতেশের নাম না করে মোদী এক দিকে তৃণমূল নেত্রীকে ‘বাবুয়া’-র (অখিলেশ) ‘নতুন বুয়া’ বলে বোঝাতে চেয়েছেন। অন্য দিকে অভিযোগ তুলেছেন যে, তৃণমূলের রাজনীতির অর্থ হল, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের সুরক্ষা দেওয়া, হিন্দুদের হত্যা করা, দলিতদের উৎপীড়ন। তাঁর দাবি, সমাজবাদী পার্টি সেই পথেই নিয়ে যেতে চাইছে উত্তরপ্রদেশকে।
প্রধানমন্ত্রীর এই আক্রমণের জবাব দিতে গিয়ে আজ সন্ধ্যায় তৃণমূলের রাজ্যসভার নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেছেন, “নরেন্দ্র মোদী, আপনাকে কিছু বলার শব্দ নেই। আপনাকে শুধু একটি সংখ্যায় বর্ণনা করা যায়। তা হল, চারশো বিশ! মূল্যবৃদ্ধি এবং বেকারত্ব নিয়ে আপনি কথা বলেন না। শুধুমাত্র ঘৃণা ছড়ান। ২০০২-এর ঘটনা কি কেউ ভুলে গিয়েছেন?’’ ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির হারের পরে একশো দিনের কাজ অথবা আবাস যোজনার একটি টাকাও বাংলাকে দেওয়া হয়নি বলে ফের অভিযোগ তুলেছেন ডেরেক। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তাঁর মন্তব্য, ‘‘সন্দেশখালি নিয়ে আপনার নোংরা খেলা সবার সামনে উন্মোচিত হয়ে গিয়েছে।”
প্রধানমন্ত্রী আজ ভদোহীতে তাঁর বক্তৃতা শুরুই করেন কংগ্রেস এবং এসপি-র পাশে তৃণমূলকে বিশেষ ভাবে চিহ্নিত করে। বলেন, “ভদোহীতে এসপি এবং কংগ্রেসের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যাওয়ার জোগাড়। তাই তারা ময়দান ছেড়ে পালিয়েছে। সেই সুযোগে তৃণমূল এখানে বাংলার রাজনীতির একটা পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করতে চাইছে।” জনতার উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে নিজেই বলেন, “আপনারা জানেন, বাংলায় তৃণমূল কী ভাবে রাজনীতি করে? তৃণমূলের রাজনীতির অর্থ, তোষণের বিষাক্ত তির নিক্ষেপ। তৃণমূলের রাজনীতি, রামমন্দিরকে অপবিত্র বলা। রামনবমী উদ্যাপন বন্ধ করে দেওয়া। তৃণমূলের রাজনীতির অর্থ, বাংলাদেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীদের সংরক্ষণ দেওয়া, মূলস্রোতে ভোট-জিহাদ নিয়ে আসা। হিন্দুর হত্যা, দলিত-জনজাতির পীড়ন, মহিলাদের উপরে অত্যাচার।”
সম্প্রতি বহরমপুরের তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ুন কবীরের বিতর্কিত ভিডিয়ো নিয়ে সরব হয়েছিল বিজেপি। সেই প্রসঙ্গও টেনে এনে মোদী বলেছেন, “বাংলায় তৃণমূলের বিধায়ক কী বলছে জানেন? বলছে, হিন্দুদের গঙ্গায় ডুবিয়ে মারব। এসপি উত্তরপ্রদেশকে আসলে এই দিকে নিয়ে যেতে চায়।”
গত লোকসভা ভোটে বিএসপি নেত্রী মায়াবতী এবং অখিলেশ জোট গড়ে মোদীর বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। ফলাফলে মুখ খুবড়ে পড়ে সেই জোট। এর পরে গত পাঁচ বছর মায়াবতীকে এক বারের জন্যও বিজেপি তথা মোদীর বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নিতে দেখা যায়নি। সূত্রের মতে, তাঁর পরিবারের উপরে ইডি-র চাপও বহাল রয়েছে। এ বার অবশ্য ‘বহেনজি’ লড়ছেন আলাদা। তা নিয়েই ব্যঙ্গ করে মোদী বলেন, “আগে বুয়া (মায়াবতী) বাবুয়ার (অখিলেশ) জোট হয়েছিল। কিন্তু বুয়া, বাবুয়ার আসল চেহারা চিনতে পেরে এসপি-কে ছেড়ে পালিয়েছেন! এ বার বাংলা থেকে নতুন বুয়া (মমতা) নিয়ে এসেছেন বাবুয়া! তাঁদের খেলা চলছে উত্তরপ্রদেশে। এঁদের থেকে কয়েকশো মাইল দূরে থাকবেন আপনারা।” আক্রমণ আরও তীক্ষ্ণ করে মোদীর বক্তব্য, “এসপি-র শাহজাদাকে একটা প্রশ্ন করতে বলি। বাংলার বুয়া তো আপনার এতই ঘনিষ্ঠ! ওঁকে এক বার জিজ্ঞাসা করুন তো, বাংলায় কেন বিহার-উত্তরপ্রদেশের মানুষ গেলে তাঁদের বাইরের লোক বলা হয়? একটাই দেশ, আমরা সবাই ভারতীয়, ভারতমাতার সন্তান। তা হলে তৃণমূল কেন তাঁদের গালি দেয়? বাবুয়া, একটু আপনার বুয়ার কাছে জানতে চান এর উত্তর। বাংলায় উত্তরপ্রদেশের মানুষকে গালি দিয়ে এখন সেই উত্তরপ্রদেশে এসে ভোট চাইতে হচ্ছে কেন?”
এ দিকে, আজই লখনউতে সাংবাদিক সম্মেলন করে আপ নেতা অরবিন্দ কেজরীওয়াল এবং এসপি নেতা অখিলেশ যাদব নিশানা করেছেন মোদী তথা বিজেপিকে। আজও যোগীর প্রসঙ্গ তুলে কেজরীওয়াল বলেছেন, “অমিত শাহের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথের কাঁটা একমাত্র যোগী আদিত্যনাথ। এ বার বিজেপি লোকসভা ভোটে জিতলে যোগীকে মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে। দু’বছর পর মোদীজি ৭৫ হয়ে যাবেন, তখন অমিত শাহই প্রধানমন্ত্রী হবেন। আমি জানি অমিত শাহ এ কথা অস্বীকার করেছেন। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ মোদীজি এখন নেতা। কিন্তু মোদীজি নিজের গড়া নিয়ম অনুযায়ী ৭৫-এর পরে অবসর নিতে বাধ্য। তা যদি তিনি না নেন, তা হলে মানুষ বলবে শুধুমাত্র আডবাণীজিকে সরানোর জন্য তিনি ৭৫ বছরে অবসরের নিয়ম বানিয়েছিলেন।”
এ বার ক্ষমতায় এলেই মোদী সংবিধান বদলে দেবেন বলে অভিযোগ কেজরীওয়াল-অখিলেশের। তাঁর কথায়, “ওরা বলছে ৪০০ পার। অর্থ হল, চারশোর পরে (লোকসভায়) যে সংখ্যা পড়ে থাকবে, সেটাই ওরা পাবে! অর্থাৎ ১৪৩টি আসন!” কেজরীওয়ালের কথায়, “মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, দিল্লি, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, কর্নাটক— সর্বত্র বিজেপির আসন কমছে। সব মিলিয়ে ২৩০-এর নীচে থাকবে তাদের মোট আসন।”
বিরোধীরা যখন বিজেপির আসন কমার কথা বলেছেন, তখন মোদী উত্তরপ্রদেশের প্রতাপগড়ের জনসভায় দাবি করেছেন, তাঁদের তৃতীয় দফার সরকার আরও শক্তিশালী হবে। মোদীর কথায়, “আজ ভারত জি২০-র মতো বড় ইভেন্টের আয়োজন করছে চূড়ান্ত সাফল্যের সঙ্গে। চাঁদের মাটিতে তেরঙ্গা পতাকা পুঁতেছে। ১০ বছর আগে এই সাফল্য আপনারা কল্পনা করতে পারতেন? হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি ছাড়া অন্য কোনও খবর পেতেন? যা আগে অসম্ভব ছিল, তা আজ সম্ভব হয়েছে। কিন্তু তা মোদীর জন্য হয়নি। আপনাদের ভোটের শক্তির কারণেই হয়েছে। আর তাই আজ গোটা দেশ বলছে, এই সরকারের তৃতীয় পর্ব আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠবে।”