ফুটবলের রেসে ভারত শুরু থেকেই দু’পাক পিছনে! আনন্দবাজার অনলাইনে সাক্ষাৎকার এআইএফএফ সভাপতি কল্যাণ চৌবের
আনন্দবাজার | ১৯ মে ২০২৪
প্রশ্ন: ভারতীয় ফুটবল যে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে, এটা মানবেন?
কল্যাণ চৌবে: খেলোয়াড় হিসাবেও এটা শুনতে হয়েছে। এখন সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি হিসাবে এই কথাটা আরও বেশি করে শুনতে হয়। সবার প্রশ্ন, ভারতীয় ফুটবল কেন এত পিছিয়ে? আইসল্যান্ডের মতো ছোট্ট একটা দেশ আমাদের থেকে ফুটবলে এগিয়ে। উত্তরটা খুঁজতে গেলে একটু ইতিহাস ঘাঁটতে হবে। ভারত ১৯৫০ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ পরের বছর দিল্লিতে প্রথম এশিয়ান গেমস হয়েছিল। সরকারের মনে হয়েছিল, এশিয়ান গেমসে জোর দেওয়া উচিত। ছয় দেশের এশিয়ান গেমসে ভারত সোনা পেয়েছিল। ১৯৫২ থেকে ১৯৬০ অলিম্পিক্সে ভারত ভাল খেলেছিল। তখনই আমরা পিকে, চুনী, বলরামকে দেখি। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিগত কারণে আমরা বিশ্বকাপকে গুরুত্ব দিইনি। আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল শুধু এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে। অনূর্ধ্ব-১৯ যুব এশিয়া কাপে ইরানের সঙ্গে ভারত যুগ্ম ভাবে সোনা পায়। কিন্তু ২০০২ সাল থেকে নিয়ম তৈরি হয়ে যায় অলিম্পিক্স, এশিয়ান গেমসে অনূর্ধ্ব-২৩ ফুটবলারদেরই খেলানো যাবে। ২৩ বছরের বেশি বয়সের মাত্র তিন জন ফুটবলার খেলানো যাবে। ফলে বিশ্বকাপের গুরুত্ব বেড়ে যায়। আর বিশ্বকাপ না খেলায় ভারত ফুটবলের মূলস্রোত থেকে হারিয়ে যায়। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ভারত বিশ্বকাপ খেলার কথা ভাবেইনি। ১৯৮৬ সালে দিয়েগো মারাদোনাকে দেখার পর এ দেশের সরকার বা কর্তাদের উপলব্ধি হয় যে, বিশ্বকাপটাই আসল। বিশ্বকাপে খেলার আগ্রহ তৈরি হয়। কিন্তু তত দিনে ভারত পিছোতে পিছোতে র্যাঙ্কিংয়ে ৯০-১০০-১২০ তে চলে গিয়েছে। ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। রিলে রেসে বাকি ফুটবল খেলিয়ে দেশগুলোর থেকে তখনই দু’পাক পিছিয়ে পড়েছে ভারত। সবার আগে এই গ্যাপ ভরাট করার কঠিন কাজটা করতে হবে।
কল্যাণ: অবশ্যই কঠিন কাজ। এর জন্য যত দ্রুত সম্ভব ফুটবলের ওই মূল স্রোতটায় ঢুকে পড়তে হবে। মূল স্রোত মানে শুধু বিশ্বকাপ খেলা বা প্রচুর আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা নয়। ফুটবলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উন্নতি করতে হবে। এই কারণেই বার বার ফিফা (বিশ্ব ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা), এএফসি (এশীয় ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা) কর্তাদের সঙ্গে দেখা করি। বিভিন্ন কনফারেন্সে যাই। প্রাক্তন কর্তাদের কাউকে ছোট না করেই বলছি, আগে কনফারেন্সে যাওয়া মানে পরিবার নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ, কেনাকাটা, খাওয়াদাওয়া ছিল। কিন্তু ওই কনফারেন্সগুলোকে যথাসম্ভব কাজে লাগাতে হবে। আধুনিক সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে। সেগুলো কী করে কাজে লাগানো যায়, সারা ক্ষণ সেই ভাবনাটার মধ্যে থাকতে হবে। ফিফার সঙ্গে সম্পর্ক ভাল রাখতে হবে। তাইল্যান্ডে দু’দিনের ফিফা কংগ্রেস ছিল। ফিফা সভাপতির সঙ্গে বৈঠক করেছি। বিভিন্ন দেশের কর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। যতটা সম্ভব এই কনফারেন্সগুলোতে যাই, বিশ্ব ফুটবলের সঙ্গে যাতে আমাদের সম্পর্কটা ভাল হয়। সোজা কথা, নজরে থাকতে হবে। মাঠে সাফল্য আসাটা সময়সাপেক্ষ। কিন্তু এগুলো তো এখনই করা যায়।
প্রশ্ন: ফুটবলপ্রেমীদের একটাই প্রশ্ন, ভারত কবে বিশ্বকাপ খেলবে?
কল্যাণ: এটা হাত গুনে বলা যাবে না। পরের বিশ্বকাপে ৪৮টা দেশ খেলবে। এশিয়া থেকে খেলবে আটটা দেশ। ফলে সেই আটটা দেশের মধ্যে থাকতে হবে। ভারত এখন এশিয়ায় ১৮ নম্বরে। সেখান থেকে প্রথম আটে আসতে গেলে কী করতে হবে? যত বেশি সম্ভব খেলতে হবে। কোনও ফিফা উইন্ডো মিস করা যাবে না। তার পর দল যত জিতবে তত র্যাঙ্কিংয়ে উন্নতি হবে। ফুটসলের (পাঁচ জন করে দু’দলের ইন্ডোর ফুটবল) র্যাঙ্কিং প্রকাশ করেছে ফিফা (বিশ্ব ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা)। ১৩৯টি দেশের মধ্যে ভারত ১৩৫ নম্বরে। কেন এত পিছিয়ে? তার কারণ ভারত খেলেই না ফুটসল। মূল ফুটবলের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তা-ই।
প্রশ্ন: উন্নতি হচ্ছে কোথায়? দেখতে পাচ্ছেন?
কল্যাণ: আমরা ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ১০০ থেকে ১২০-তে নেমে গিয়েছি। কেন? আমরা ফিফা উইন্ডো ঠিক মতো কাজে লাগাতে পারিনি। বছরে চার-পাঁচটা আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা হতো। তাই র্যাঙ্কিংয়ে উন্নতি হয়নি। সেই জায়গায় গত বছর ভারতীয় দল ২৫টা ম্যাচ খেলেছে। তাইল্যান্ড, মণিপুর, ভুবনেশ্বর, মালয়েশিয়ায় খেলেছে। কিন্তু আমাদের থেকে র্যাঙ্কিংয়ে নীচে থাকা মালয়েশিয়া, আফগানিস্তানের কাছে আমরা হারলাম। যখনই নীচে থাকা দলের কাছে হারছি, র্যাঙ্কিং আরও পড়ে যাচ্ছে। তাই ফিফা উইন্ডো ব্যবহার করার সময় স্ট্র্যাটেজিক্যালি এগোতে হবে। এমন দেশকে বাছতে হবে, যাদের সঙ্গে খেললে আমাদের উপকার হয়। অর্থাৎ, ম্যাচের সংখ্যা যেমন বাড়াতে হবে, তেমনই এমন দেশের সঙ্গে খেলতে হবে যেখানে সমমানের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে।
প্রশ্ন: ভারতীয় ফুটবল কি আইকনের অভাবে ভুগছে? ক্রিকেটে একটা ধোনি আছে, কোহলি, রোহিত আছে। ফুটবলে তো গত ৩০ বছরে ভাইচুং ভুটিয়া আর সুনীল ছেত্রী ছাড়া আর কেউ নেই। ক’দিন পর সুনীলও থাকবে না।
কল্যাণ: ফুটবলকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা সুনীলের। এটা সত্যি, আইকন না থাকলে জনমানসে সেই প্রভাব পড়ে না। কিন্তু আমি বলব, শূন্যস্থান বলে কিছু হয় না। এটা প্রকৃতির নিয়ম, জীবনের নিয়ম। কেউ না কেউ উঠে আসবেই। ছাংতে, মনবীরেরা এই জায়গা যে নেবে না, কে বলতে পারে? সুনীল ১৯ বছর খেলছে। তখন কি ভেবেছিল এই জায়গায় পৌঁছবে? এটা সব ক্ষেত্রেই সত্যি। এক-দু’বছরে তো অমিতাভ বচ্চন হওয়া যায় না। এখন খেলোয়াড়েরা অনেক পেশাদার, সুশৃঙ্খল। ফলে আইকন অবশ্যই আসবে।
প্রশ্ন: কিন্তু এ দেশের ফুটবল নিয়ে মানুষের আগ্রহ তো হারিয়ে যাচ্ছে। যেমন কলকাতা লিগ, কোথায় সেই উন্মাদনা?
কল্যাণ: একটা সময় রাজ্যের ফুটবলে কলকাতা লিগই একমাত্র ছিল। তিন প্রধান গুরুত্ব দিয়ে খেলত। এখন সেটা নেই। অথচ কলকাতা ফুটবল তিন প্রধান-কেন্দ্রিক। এর বাইরে কোনও ক্লাবের সেই জনসমর্থন নেই। এটা একটা চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি। প্রতিকূল পরিস্থিতি। আইএফএ যদি মনে করে ফেডারেশনের সহযোগিতা দরকার, আমরা করব। রাজ্যের ফুটবলের উন্নতি না হলে জাতীয় ফুটবলের উন্নতি হবে না। এটা আমাদের দায়িত্ব।
প্রশ্ন: তিন প্রধান কলকাতা লিগকে গুরুত্ব দেবে কেন বলুন তো? জাতীয় দলের কোচ তো সেখানে ফুটবলার ছাড়েন না চোটের ভয়ে।
কল্যাণ: অবশ্যই খেলতে দিতে হবে। আমার কেরিয়ারের শুরুর দিকে নিয়ম করা হয়েছিল বছরে ৪৫টার বেশি ম্যাচ খেলা যাবে না। প্রতিটা ম্যাচে টোকেন সই করে খেলতে হত। যে যত বেশি খেলবে তত পরিণত হবে। হারা-জেতার মধ্যে দিয়েই তো শেখা। চোটের কথা কোচেরা বলেন। কিন্তু কেউ তো প্র্যাকটিসেও চোট পেতে পারে। অমুক প্রতিযোগিতায় খেললে চোট লাগবে, অন্যটায় খেললে চোট লাগবে না, এ রকম তো নয়। খেলতে তো হবে। এটা মেনে নিতে হবে। তবে বিভিন্ন কোচের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি আছে।
প্রশ্ন: কলকাতার তিন প্রধানের কথা বললেন। কিন্তু এখন তো ডার্বি ম্যাচেও মাঠ ভরছে না। দলবদলের সেই উন্মাদনা নেই। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান নিয়েও কি আবেগ কমেছে?
কল্যাণ: সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই বদলে যায়। একটা সময়ে খেলোয়াড়দের তুলে নেওয়া হত। পল্টু দাসের (ইস্টবেঙ্গলের প্রাক্তন সচিব) মতো চরিত্র ছিলেন। উন্মাদনা ছিল। দলবদলের মজা ছিল। দলবদলের টোকেন নেওয়ার পর ফুটবলারদের আটকে রাখা হত। এখন যুগ বদলেছে। সিস্টেম বদলেছে। গোটা ফুটবল বিশ্বেই এটা হয়েছে। দলবদলে শান্তি, শৃঙ্খলা এসেছে। অনেক সংগঠিত হয়েছে। এটা মেনে নিতে হবে।
প্রশ্ন: এই রাজ্য আগে ভারতীয় ফুটবলের সাপ্লাই লাইন ছিল। এখন বাঙালি ফুটবলার কোথায়? ভারতীয় দলে এক জন মাত্র বাঙালি!
কল্যাণ: এটা দুর্ভাগ্যজনক। বাঙালি ফুটবলার কেন কমে গেল, এর কোনও তাৎক্ষণিক উত্তর আমার কাছে নেই। এটুকু বলব, প্রতিযোগিতার সংখ্যা বাড়াতে হবে। বেশি ম্যাচ খেলতে হবে।
প্রশ্ন: ভারত বিশ্বকাপ জেতার পর ক্রিকেটের ছবিটা বদলে গেল। ফুটবলেও কি আগে সে রকম সাফল্য দরকার?
কল্যাণ: এখানেও আমি ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসটা তুলে ধরতে চাই। একেবারে শুরুতে যে কথাটা বললাম, সেটা আবার মনে করিয়ে দিতে চাই। ফুটবলের ফাউন্ডিং মেম্বারদের মধ্যে না থাকাটা ভারতের জন্য বড় ক্ষতি। সাত জন সদস্য নিয়ে ফিফা শুরু হয়েছিল ১৯০৪ সালে। আইএফএ (বঙ্গের ফুটবল নিয়ামক সংস্থা) স্থাপিত হয়েছিল ১৮৯৩ সালে। ভাবুন! ফিফার থেকেও বয়সে বড় এই রাজ্যের ফুটবল সংস্থা। কিন্তু এই ইতিহাস, ঐতিহ্যটা কাজে লাগাতে পারেনি ভারতীয় ফুটবল। ভারত যদি শুরুতে কোনও ভাবে মূলস্রোতে ঢুকে পড়তে পারত, প্রথম দু’-তিনটে বিশ্বকাপ খেলে ফেলত, ছবিটা অন্য রকম হত। তখন ১৫-১৬টা দেশ নিয়ে বিশ্বকাপ হত। কে বলতে পারে, খেললে ভারত সেমিফাইনালে যেত না? ক্রিকেটে তো সেটাই হয়েছে। জেতার মধ্যে দিয়ে যে জাতীয়তাবোধ তৈরি হয়, সেটা আর কোনও কিছুর সঙ্গে তুলনীয় নয়। ভারতীয় ফুটবল শুরু থেকে সেই সুযোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৮৩ সালে ক্রিকেট যেটা করেছে, ১৯৫০ সালে ফুটবল যদি করত, এই সমস্যা হত না।
প্রশ্ন: ভারতীয় ফুটবলে কি এক জন ললিত মোদীকে দরকার?
কল্যাণ: জাঁকজমক করে ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি লিগ হতে পারে। কিন্তু ওই যে বললাম, সবার আগে বুঝতে হবে রিলে রেসে আমরা দু’পাক পিছিয়ে। আইএসএল তো কোনও অংশে কম নয়। আমি তো বলব, এশিয়ার ৪৭টা দেশের লিগের মধ্যে সেরা পাঁচে থাকবে। অন্তত বিনিয়োগের দিক থেকে। ২০১৪-র আগে আমরা দেখতাম মাঠের সেন্টার লাইনের পাশে ঘাস উঠে গিয়েছে। গোলকিপারদের জায়গাটা ন্যাড়া। এগুলো এখন দেখতে পাবেন না। আজ প্রতিটা মাঠ বিশেষ ভাবে তৈরি। পরিকাঠামোগত উন্নতি অবশ্যই হয়েছে। দুপুরের কাঠফাটা রোদে খেলা হচ্ছে না, দলগুলো বিলাসবহুল হোটেলে থাকছে, ট্রেনে যাতায়াত করতে হচ্ছে না, টেলিভিশনে সম্প্রচারের মান বেড়েছে। কিন্তু উন্নতিটা জাতীয় দলে প্রতিফলিত হচ্ছে না। কারণ বাকিরা বসে নেই। তারা দু’পাক এগিয়ে আছে।
প্রশ্ন: ক্রিকেটে এক জন জয় শাহ আছেন। ফুটবলেও কি ওঁর আসা উচিত?
কল্যাণ: ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সুবিধা, সেখানে অর্থাভাব নেই। ফেডারেশন রাজ্যগুলোকে সাহায্য করতে চাইলে বা রাজ্যগুলো জেলাকে সাহায্য করতে চাইলেও যে খরচ তা বহন করার সামর্থ্য দরকার। আমাদের চেয়েচিন্তে এক-একটা প্রতিযোগিতা করতে হয়। শতাব্দীপ্রাচীন আইএফএ শিল্ড বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
প্রশ্ন: আইপিএলের মাধ্যমে বছরের পর বছর ক্রিকেট বোর্ডের যে মোটা টাকা আয় হয়, আইএসএলের ফলে ফেডারেশনের তো তা হয় না?
কল্যাণ: আইএসএলের তো আমাদের টাকা দেওয়ার কথা নয়। টাকাটা যায় এফএসডিএলের (আইএসএলের আয়োজক) কাছে। ফেডারেশনের সরাসরি লাভ বা ক্ষতি নেই। এই সুযোগটা বাকি প্রতিযোগিতাগুলোয় আছে। কিন্তু আমরা করে উঠতে পারিনি। যেমন টিকিট বিক্রি থেকে লাভ, টেলিভিশন স্বত্ব বিক্রি। মেয়েদের ক্রিকেটের টেলিভিশন স্বত্ব ৫ হাজার কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছে। আই লিগের জন্য যদি এটার ধারেকাছেও কিছু করা যেত! কোনও একটা জায়গায় নিশ্চয়ই পিছিয়ে রয়েছি আমরা। ফুটবল সে ভাবে ভাবেনি বা করেনি।
প্রশ্ন: বিসিসিআই স্বশাসিত সংস্থা। আরটিআই (তথ্যের অধিকার আইন)-এর আওতায় পড়ে না। কেন্দ্রের মুখাপেক্ষী নয়। ফুটবলে এর উল্টো ব্যবস্থা। এর জন্য কি হাত-পা ছড়াতে সমস্যা হয়?
কল্যাণ: সব অলিম্পিক্স স্পোর্টসই কেন্দ্রের কাছ থেকে সাইয়ের মাধ্যমে সাহায্য পায়। এটাই সিস্টেম। ক্রিকেট যদি অলিম্পিক্সের অন্তর্ভুক্ত হয়, বোর্ড চাইলে সেই সিস্টেমের মধ্যে আসতে পারে। তবে আসবে কি না সেটা ওদের ব্যাপার।
প্রশ্ন: ক্রিকেট, আইপিএল কি ক্ষতি করছে না ভারতীয় ফুটবলের? সব ঝোল কি ওরাই খেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে না?
কল্যাণ: ১৪২ কোটির দেশে কোনও একটা খেলা সব মানুষকে একসঙ্গে আকৃষ্ট করতে পারে বলে মনে হয় না। আমাদের থেকে অনেক কম জনসংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন দেশ দিব্যি একাধিক খেলা খেলছে। ১০ কোটির নীচে জনসংখ্যা, এ রকম ৫০-৬০টা দেশ রয়েছে। তারা কি একাধিক খেলা খেলে না? আমাদের দেশে ক্রিকেট ছাড়া অন্য খেলায় সেই আন্তর্জাতিক সাফল্য নেই। তাই ক্রিকেট জনপ্রিয়। ফুটবলের কিন্তু একটা স্বাভাবিক জনপ্রিয়তা আছে। ক্রিকেটের থেকে ফুটবল অনেক বেশি মানুষ ফলো করে। শহুরে বাচ্চাদের কাছে ক্রিকেটের থেকে ফুটবল বেশি আনন্দের।
প্রশ্ন: আইএসএলের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা সংশয় দেখা দিয়েছে। সেটা কেটে যাবে?
কল্যাণ: কোনও সংশয় বা অনিশ্চয়তা নেই। ১০ বছর পূর্ণ করল আইএসএল। এফএসডিএলের সঙ্গে আগামী বছর আমাদের চুক্তি শেষ হচ্ছে। একটা সন্ধিক্ষণ, ট্রানজ়িশন পিরিয়ড। এই পর্যন্ত। কোনও অনিশ্চয়তা নেই।
প্রশ্ন: মহমেডানকে ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি ফি ছাড়াই আইএসএল খেলতে দেওয়া হবে। এটা ঠিক?
কল্যাণ: টাকার বিকল্প আছে। কিছু টাকা কম পড়লে এ দিক-ও দিক থেকে সেটা ম্যানেজ হয়ে যায়। জীবনে টাকাটাই সব নয়। কিন্তু যদি লক্ষ্যটাই শেষ করে দেওয়া হয়, তা হলে আর কিছু করার থাকে না। আই লিগ জেতার পর যদি আর সামনে কোনও লক্ষ্য না থাকে, তা হলে তারা খেলবে কেন? আমার উদ্যোগে আই লিগে প্রমোশন চালু হয়েছিল। গত বছর পঞ্জাব এফসি, এ বার মহমেডান উঠেছে। মনে হয় সব ফুটবলপ্রেমীরই খুশি হওয়া উচিত।
প্রশ্ন: আইএসএলের জন্য ভারতীয় ফুটবলের উপর থেকে ফেডারেশনের নিয়ন্ত্রণ চলে গিয়েছে। মানেন এটা?
কল্যাণ: একেবারেই নয়। কাগজে-কলমে আইএসএল-সহ সব প্রতিযোগিতাই ফেডারেশনের নিয়ন্ত্রণে। শুধু মার্কেটিংটা এফএসডিএলের হাতে। যখন দরকার হয় আমরা আলোচনা করি। গত বছর রেফারিং নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। আমাদের চিফ রেফারিং অফিসার বিষয়টায় হস্তক্ষেপ করেছেন। ওঁর বেতনের অর্ধেকটা আমরা দিই, বাকিটা এফএসডিএল দেয়। পুরোটাই যৌথ প্রক্রিয়া।
প্রশ্ন: ফেডারেশন সভাপতি হিসাবে আপনার দেড় বছর কী ভাবে দেখবেন?
কল্যাণ: নিজের মূল্যায়নের জন্য আমি একটা রিপোর্ট তৈরি করেছি। আমার ১৮ মাসে কী হয়েছে, তার আগে কী হয়েছে। বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ফিফা, এফসির সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় হয়েছে। আর্সেন ওয়েঙ্গারের মতো কোচ ভারতীয় ফুটবলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। একাধিক ফিফা অ্যাকাডেমি তৈরি হয়েছে। আরও হবে। মহিলা ফুটবলারের রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যা ১৩৮ শতাংশ বেড়েছে। ‘ফুটবল ফর স্কুল’-এ ১ লক্ষ ৫৫ হাজার ৯১২টা স্কুল যুক্ত হয়েছে। আমরা ১০ লক্ষ ফুটবল দিয়েছি স্কুলগুলোকে। পিটি-র চিটারদের ফুটবলের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। ভারত গত বছর ২৫টা ম্যাচ খেলেছে। সেই সুযোগ করে দিয়েছি। হোম-অ্যাওয়ে ভিত্তিতে মেয়েদের লিগ করছি। আই লিগ ৩ শুরু করেছি। রাজ্য লিগগুলোতে বিদেশি ফুটবলারদের খেলা বন্ধ করেছি। নীচের স্তরে বিদেশিদের খেলা বন্ধ না করলে হবে না। গণ্ডগ্রামেও নাইজিরীয় স্ট্রাইকারকে খেলতে দেখেছি। সারা দেশে ১০ হাজার ক্লাব। চারটে করে স্ট্রাইকারের মধ্যে গড়ে তিন জন বিদেশি খেলত। এটা বন্ধ করেছি।
প্রশ্ন: এআইএফএফ সভাপতি হিসাবে আপনার সেরা সাফল্য কী?
কল্যাণ: দশ বছর পরে যদি অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপে ভারত যোগ্যতা অর্জন করে খেলতে পারে, সেটাই আমার সেরা সাফল্য হবে। এটাই লক্ষ্য স্থির করেছি। শুধু আয়োজক দেশ হিসাবে ভারত ছোটদের বিশ্বকাপে খেলুক, এটা চাই না। এটা করা সম্ভব। এই জন্য ভুবনেশ্বরে ফিফা অ্যাকাডেমি হয়েছে। ওয়েঙ্গারের তত্ত্বাবধানে যারা তৈরি হবে, তারা ওই বিশ্বকাপটা খেলবে। সেটাই আমার সেরা সাফল্য হবে।
প্রশ্ন: ফেডারেশনের নির্বাচনের সময় ভাইচুং ভুটিয়ার সঙ্গে আপনার একটা খোলাখুলি বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। দূরত্ব কি মিটেছে?
কল্যাণ: নির্বাচনে সব সময় বিতর্ক থাকবে। প্রতিপক্ষের সমালোচনা হবে। এটা নির্বাচনের নিয়ম। মনে হয় না নির্বাচনের পরে এগুলো নিয়ে আর কোনও পক্ষই মাথা ঘামায়।
প্রশ্ন: রাজনীতিবিদ কল্যাণ চৌবের ভবিষ্যৎ কী? কী লক্ষ্য রেখেছেন?
কল্যাণ: কোনও লক্ষ্য নেই। রামকৃষ্ণদেব বলেছেন, জন্মেছিস যখন দাগ কেটে যা। সেটাই করব। যখন থাকব না তখনও মানুষ যেন মনে করে এই লোকটা সাধ্য মতো করেছে। রাজনীতি হোক বা ক্রীড়া প্রশাসন— এই দর্শনেই এগোতে চাই। এক একটা দিন ধরে, ছোট ছোট লক্ষ্য রেখে এগোতে চাই। প্রার্থনা করি, পরের দিনটা যেন আর একটু ভাল হয়।
প্রশ্ন: খেলা, ক্রীড়া প্রশাসন, রাজনীতি— কোনটা বেশি কঠিন?
কল্যাণ: তিনটেই। সহজে তো কিছু হয় না। পরিশ্রম করতে হয়। খিদে পেলে শিশুকেও কাঁদতে হয়। তবে সে খাবার পায়।
প্রশ্ন: রাজনৈতিক কারণে যদি ফুটবল প্রশাসকের দায়িত্ব ছাড়তে হয়, কী করবেন?