• রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কর্মজীবন শুরু ও শেষের কলেজ- ‘বিদ্যানগর কলেজ’
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ২০ মে ২০২৪
  • নিশীথ সিংহ রায়
    ১৯৬৩ সালের ২৯ জুলাই কলকাতার অনতিদূরে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বিদ্যানগরে ?বিদ্যানগর? কলেজ (মহাবিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠিত হয়৷ যে কলেজে ভারতের একমাত্র বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁর শিক্ষকতা শুরু ও শেষ করেন৷ তিনি এখানে ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল প্রায় পাঁচ বছর শিক্ষকতা করেন৷ এরমধ্যে ১৯৬৬-৬৭ প্রণববাবু বিদ্যানগর কলেজের Officiateing Principal ছিলেন৷ আর ১৯৬৯ সালে তিনি তো কলেজের চাকরি ছেডে় পাকাপাকি ভাবে রাজনীতির মঞ্চে নেমে পডে়ন৷ আস্তে আস্তে তিনি হয়ে ওঠেন ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ক্ষেত্রের একজন মহীরুহ৷ আসি বিদ্যানগরের কথায়৷ গ্রামগঞ্জের গন্ধ মাখা সাধারণ এলাকার নাম বিদ্যানগর, তার নেপথ্যে ছিল ব্যাপক বিদ্যাচর্চার আয়োজন৷ জায়গাটার স্থানীয় নাম চড়াশ্যাম দাস হলেও সে নাম এখন আর কারও মুখে আসে না৷ কাগজে কলমে থেকে গেছে৷ সর্বসাধারণের কাছে আজ তা ?বিদ্যানগর?৷ আজ আমাদের ঘুরে দেখা সেই বিদ্যানগর কলেজ৷ কলেজে ঢুকতেই মনে হয়েছিল এ কোনো এক বড়ধরনের নার্সারিতে ঢুকেছি৷ চারিদিকে শুধু ফল-ফুলের গাছ৷ ফুলের সৌরভে মাতোয়ারা কলেজের পরিবেশ৷ ফুলের বাগানের মধ্যে বিদ্যানগর কলেজ অবস্থিত বললেও যেন অতু্যক্তি হয় না৷ চার-পাঁচ বিঘা জমির ওপরে বিশাল বাগান৷ বলতেই হবে কলেজ ম্যানেজমেন্ট বিশেষত অধ্যক্ষ ডঃ সূর্য প্রকাশ আগরওয়ালার কথা৷ যাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম ও চেষ্টায় কলেজটি আজ এক অনুপম সৌন্দর্যের অধিকারী৷ পরে এই নিয়ে বিস্তারিত লিখবো৷
    এই কলেজের গোড়াপত্তন করেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ধীরেন্দ্রনাথ বেরা৷ তাঁকে বলা হয় বিদ্যানগরের রূপকার৷ শুধুমাত্র বিদ্যানগর কলেজ নয়, বালক-বালিকাদের জন্য দু?টি পৃথক উচ্চ বিদ্যালয়, দু?টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, জেলা গ্রন্থাগার, ডাকঘর প্রভৃতি সমাজের বিকাশের জন্য যা যা প্রয়োজন সবই তাঁর উদ্যোগে বিদ্যানগর এলাকায় গডে় ওঠে৷ এই সব মিলেই বিদ্যানগর৷ ব্যবসায়ী নয়, ধীরেন্দ্রনাথ বেরা এখানকার মানুষের কাছে যথার্থই ?সমাজ সংস্কারক?৷ ধীরেন্দ্রনাথ বাবুর প্রতিষ্ঠিত কলেজ ?বিদ্যানগর? আজ সত্যিই বিদ্যানগরবাসীর গর্ব৷ একটি সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত কলেজ যে স্থানীয় জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হতে পারে তা ওখানে না গেলে বুঝতে পারতাম না৷
    কলেজের ব্যাপারে জানতে আমরা যখন কলেজে পৌঁছলাম কলেজের অধ্যক্ষ সূর্যবাবু এবং বাংলার অধ্যাপক অবশেষ দাসবাবু আমাদের কলেজ ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন এবং কলেজের বর্তমান বিশাল কর্মকান্ডের সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করলেন৷ সত্যিই অবাক করার মতো কান্ড৷ কি নেই কলেজে বা সমাজ হিতকর কোন্ কাজের সঙ্গে যুক্ত নয় কলেজ! পঠনপাঠনের সঙ্গে সঙ্গে শরীর চর্চা, খেলাধূলা, সংস্কৃতি, পরিবেশ সচেতনতা, সমাজসেবা এমনকি ভারত যে কৃষিপ্রধান দেশ, কৃষি আমাদের ভিত্তি সেব্যাপারেও এখানে শিক্ষার্থী এবং এলাকাবাসীকে সদা সজাগ করে হচ্ছে৷ এককথায় বলা যায়, বিদ্যানগর কলেজ আদর্শ মানুষ তৈরির কারিগর৷
    কলেজে বর্তমান ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় চার হাজার৷ এই কলেজটিতেও অন্যান্য কলেজের মতো ছাত্রী সংখ্যার অনুপাত বেশি৷ এখানে ষাট শতাংশের ওপর ছাত্রী৷ বাষট্টি জন শিক্ষক-শিক্ষিকা ও আঠারোজন অশিক্ষক কর্মচারী কলেজকে তার গৌরব ধরে রাখতে অবিরত সাহায্য করে যাচ্ছেন৷ স্নাতক স্তরে মোট চোদ্দটি বিষয় পড়ানো হয়৷ তারমধ্যে বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতি, বি.কম, গণিত ও প্রাণীবিদ্যা এই ন?টি বিষয়ে অনার্স বা মেজর বিষয় পড়ানো হয়৷ কলা, বানিজ্য ও বিজ্ঞান তিনটি বিভাগেই এখানে অনার্স পড়ানো হয়৷ এখানে শুধুমাত্র দিবা বিভাগ আছে৷ লেখাপড়ার ক্ষেত্রে কলেজটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ উচ্চাসনে আসীন৷ এছাড়া ২০০৬ সাল থেকে রবীন্দ্রনাভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর কোর্সও এখানে পড়ানো হয়৷ যেটা দূরবর্তী কোর্স৷ বাংলা, ইংরেজি, দর্শন, ইতিহাস সহ আরও কয়েকটি বিষয়৷ দূরবর্তী বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের পড়াশুনার মানও খুবই ভালো বলেই জানা গেলো৷
    বিদ্যানগর কলেজের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও আলোকিত একটি বিভাগ৷ এই বিভাগ থেকে দুটি দেওয়াল পত্রিকা ?অঙ্কুর? ও ?অন্বেষা? নিয়মিত প্রকাশিত হয়৷ বলা যায়, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে জডি়য়ে আছে এই বিভাগের নাম৷ যেখানে অধ্যাপনা করেছেন কালজয়ী ?কবিপত্র? এর সম্পাদক ও শক্তিমান কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়৷ যিনি রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছিলেন৷ এই বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন সাহিত্যিক নিমাই চন্দ্র পাল ও বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী শুভেন্দু বারিক৷ বর্তমানে এই বিভাগের সঙ্গে যুক্ত আছেন এই সময়ের বিশিষ্ট দুই কবি ও প্রাবন্ধিক ড.বনানী চক্রবর্তী ও অবশেষ দাস৷ তাই বলা যায় শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নামই নয় অনেক বিখ্যাত ও প্রতিথযশা ব্যক্তিত্বের নাম এই কলেজের সঙ্গে যুক্ত৷ বিদ্যাগনগর কলেজের বাংলা বিভাগ শুধু নয়, ইতিহাস ও দর্শন বিভাগ থেকে দুটি দেওয়াল পত্রিকা ছাত্রছাত্রীদের হাতে প্রকাশ পায়৷ কলেজের আর এক ঐতিহ্য ?উত্তরণ ?৷ তিন দশকের বেশি কাল ধরে প্রকাশিত সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা৷ বিজ্ঞান মনস্কতাও রয়েছে এই পত্রিকার৷ সারাবছর ধরে বিভিন্ন বিভাগের পক্ষ থেকে লেখাপড়ার পাশাপাশি কলেজ ক্যাম্পাসে বিভিন্ন বিষয়ে সাংস্কৃতিক যজ্ঞ চলে বলা যায়৷
    আসি শিক্ষা ছাড়া কলেজের অন্যান্য কর্মকন্ডের ব্যাপারে৷ প্রথমে আসি শিক্ষার পরে আমাদের যা দরকার সেই স্বাস্থ্যের কথায়৷ কলেজে দু?টি ব্যায়ামাগার আছে৷ একটি ছাত্রদের ও আর একটি ছাত্রীদের৷ যেগুলি ইউ. জি. সি. কলেজকে তৈরি করতে সাহায্য করেছে৷ এখানে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ট্রেনার আছে যাঁরা ব্যায়াম করার ক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীদের গাইড করেন৷ অধ্যক্ষ বললেন, এর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কলেজে যোগা কেন্দ্রও আছে৷ যা খুবই উচ্চমানের৷ বললেন, আমাদের যোগা কেন্দ্র শুধু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেই নয়, সারা দেশের মধ্যে এক অনন্য স্থানের অধিকারী৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত ?যোগা? প্রতিযোগিতায় এই কলেজ প্রতিবারই খুব ভাল ফলাফল করে৷ ভারতবর্ষের যেকোনো জায়গায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যখন যোগা টিম পাঠায় সেখানে কলেজের প্রতিনিধি থাকেই৷ যোগা প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষকরাই তালিম দেন৷ এনারা কলেজেরই শিক্ষক যাঁরা সাই থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত৷ শিক্ষা শেষে শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেট দেওয়া হয়৷ এখানে প্রশিক্ষণ প্রাপ্তরা ভারতের বিভিন্ন জায়গায় যোগা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত৷ আমাদের খুব গর্বের ব্যাপার যে আমাদের এখানের ছয়জন যোগা শিক্ষার্থী আজ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে কর্মরত৷
    কলেজ খেলাধূলার ক্ষেত্রে বিশেষত খো খো খেলার জন্য বিখ্যাত৷ কলেজের খো খো টিম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম করা টিম৷ আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে খো খো টিম প্রতিনিধিত্ব করে সেখানে এ কলেজের প্রতিনিধিরা সর্বদা থাকে৷ এটাও কলেজের একটা গর্বের বিষয়৷ এছাড়া অন্যান্য খেলাতেও কলেজের সর্বদা একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকে৷
    সামাজিক প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে প্রধান হলো এন. এস. এস. দ্বারা পরিচালিত প্রকল্প৷ বিদ্যানগর কলেজ চারটি গ্রাম দত্তক নিয়েছে, যেখানে প্রতি মাসেই কলেজ থেকে প্রতিনিধিরা পরিদর্শনে যায়৷ মৌখালী, বেরাপাড়া, সরদার পাড়া ও উত্তর চন্দনদহ চারটি গ্রাম কলেজের আশেপাশেই৷ কলেজের তরফ থেকে এখানে মাঝে মাঝেই মেডিক্যাল ক্যাম্প করা হয়৷ যেখানে বিনা পয়সায় চক্ষু পরীক্ষা, থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা বা বাচ্চাদের পোলিও ভ্যাকসিন প্রভৃতি দেওয়া হয়৷ কলেজের ক্যাম্পাসে যে ফুল-ফলের গাছ বা রাস্তার ধারে বসানোর উপযোগী যে সমস্ত গাছ হয় তা কলেজ ক্যাম্পাসে লাগানোর পরে যা উদ্বৃত্ত থাকে তা কলেজ যেমন নিজের ক্যাম্পাসের বাইরে ফাঁকা জায়গায় লাগায় তেমনই এই চারটি গ্রামের মানুষদের মধ্যেও বিলি করে এবং তারা তা রোপন করে৷ এন. এস. এস-র তত্ত্বাবধানে কলেজের দু?শো ছাত্র-ছাত্রীদের একটা সক্রিয় টিম আছে৷ এতে প্রথম বর্ষের একশো ছাত্রছাত্রী ও দ্বিতীয় বর্ষের একশো ছাত্রছাত্রী যযরা পুরো এই প্রোগ্রামের সঙ্গে জডি়ত৷ ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ড. অলক চক্রবর্তী খুব দক্ষতার সঙ্গে এন এস এস-এর সবকিছু সামলান৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এ কাজের জন্য বছরে চল্লিশ হাজার টাকা দেয় যেটা এই কাজের পক্ষে খুবই অপ্রতুল৷ কলেজ ডেভেলপমেন্টের যে টাকা আছে সেখান থেকে অধিকাংশ খরচই হয়৷ এই যে বিশাল বাগান এর জন্যে দু?জন মালি আছে, তাদের মাইনেও এই ফান্ড থেকে দেওয়া হয়৷ কলেজের তিনটে পুকুর আছে৷ সেখান থেকে বাগানের গাছে জল দেওয়া ও কিছু মাছও হয়৷ এখানে ছয়টি মৌচাক বাক্স আছে৷ কলেজের এতবড় বাগান থাকার জন্য সেখান থেকে ভালই মধু হয়৷ যা কিছুটা বিক্রিও হয়৷ কলেজে ভারমি কম্পোজ আছে৷ সেখানে যে জৈব সার উৎপাদন হয় তাও এই বাগানে দেওয়া হয়৷ এই ছাত্রছাত্রীদের হাতেনাতে শেখানো হয় আর উদ্বৃত্ত কেঁচোও তাদের দেওয়া হয়৷ যাতে তারা তাদের বাডি়তেও ভারমি কম্পোজ করতে পারে৷ কলেজে মাসরুম চাষ হয়৷ যা বিক্রিও হয়৷ এছাড়াও আর একটা ব্যাপার৷ যেটা হলো ?ভেষজ উদ্যান?৷ জানি না আর কোনও কলেজে আছে কিনা এই ভেষজ উদ্যান৷ কলেজের ছাত্রছাত্রীরা ভেষজ গাছ সম্বন্ধে যাতে একটা সম্যক জ্ঞান উপলব্ধি করতে পারে তারজন্যই এটা করা৷
    তাই বলা যায় শিক্ষা, আভিজাত্য ও ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ ?বিদ্যানগর? কলেজ৷ একমাত্র বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে নাড়ীর যোগাযোগ ছিল এই বিদ্যানগরের সাথে আর বিদ্যানগর কলেজ শুধু তাঁর কর্মক্ষেত্র না ছিল মর্মক্ষেত্রও৷ জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি যোগাযোগ রেখেছিলেন এই কলেজের সাথে৷
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)