• ‘দো ডালি, ছহ্‌ পত্তা’! লড়ছেন তৃণমূল প্রার্থী
    আনন্দবাজার | ২১ মে ২০২৪
  • ‘বোল রাহা হ্যায় বাচ্চা-বাচ্চা, দো ডালি, ছহ্ পত্তা!’

    এই ‘দুই ডালে ছ’টি পাতা’ ব্যাপারটা কী?

    ‘বুঝলেন না, আপনাদের বাংলায় যাকে ঘাসফুল বা জোড়াফুল বলে, তাকেই আমরা এখানে ‘দুই ডাল, ছ’টি পাতা’ বলছি।’

    জোড়াফুল বললে কী অসুবিধা?

    ‘বিজেপির প্রতীকও তো পদ্মফুল। জোড়াফুল বা ঘাসফুল বললে লোকে ভুল করে বিজেপির ফুলে গিয়ে ভোট দিয়ে দিতে পারে! অনেক ভেবেচিন্তে ললিতেশভাই এক মাস আগেই ঠিক করে দিয়েছেন। বাংলায় যাকে জোড়াফুল বলে, উত্তরপ্রদেশে তাকে আমরা দো ডালি, ছহ্‌ পাত্তা বলব।’

    লোকসভা কেন্দ্রের নাম ভদোহী। রাজ্যের নাম উত্তরপ্রদেশ। প্রার্থীর নাম ললিতেশপতি ত্রিপাঠী। দলের নাম, তৃণমূল কংগ্রেস। প্রতীক— ঘাসফুল বা জোড়াফুলের বদলে ‘দো ডালি, ছহ্ পত্তা’। উত্তরপ্রদেশের ৮০টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে সমাজবাদী পার্টির সমর্থনে এই ভদোহী থেকে লড়ছে তৃণমূল কংগ্রেস।

    গাঁয়ের ধারে ছোট্ট মাঠের জনসভায় বক্তৃতা করছেন ললিতেশপতি। মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর এক অনুগামী ‘দো ডালি, ছহ্ পত্তা’-র রহস্য ব্যাখ্যা করছিলেন। ললিতেশ কার্ডবোর্ডের তৈরি নকল ইভিএম হাতে বোঝাচ্ছেন, আগামী ২৫ মে ভদোহীর ভোটে বিজেপিকে হারাতে কত নম্বরে তৃণমূলের প্রতীকের পাশে বোতাম টিপতে হবে। উপায় কী! বিজেপির পদ্মফুল, সমাজবাদী পার্টির সাইকেল, কংগ্রেসের হাত, বিএসপি-র হাতির পাশে তৃণমূলের জোড়াফুল প্রতীক চেনানোও এখানে মস্ত চ্যালেঞ্জ।

    ললিতেশপতি বা তাঁর পরিবারকে অবশ্য গোটা উত্তরপ্রদেশ এক ডাকে চেনে। বারাণসী শহর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে ভদোহী। বারাণসী জংশন স্টেশনে নামলেই প্রয়াত কংগ্রেস নেতা কমলাপতি ত্রিপাঠীর নামে ছেলেদের ও মেয়েদের আলাদা আলাদা কলেজ। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন কমলাপতি। কেন্দ্রে রেলমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর আমলেই বারাণসীতে রেল ইঞ্জিন কারখানা তৈরি হয়েছিল। বারাণসীতে ত্রিপাঠী পরিবারের বাসভবন ‘ঔরঙ্গাবাদ হাউস’ এখনও লোকে এক ডাকে চেনে। একসময়ে এই ঔরঙ্গাবাদ হাউস থেকেই না কি উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস চলত। কমলাপতির ছেলে লোকপতিও উত্তরপ্রদেশের মন্ত্রী হয়েছেন। তাঁর ছেলে রাজেশপতি বিধান পরিষদের সদস্য ছিলেন। রাজেশের ছেলে ললিতেশপতি কংগ্রেসের টিকিটে মির্জাপুরের বিধায়ক হয়েছিলেন। উত্তরপ্রদেশ কংগ্রেসের সহ-সভাপতি ছিলেন। এই সে দিনও তাঁকে কংগ্রেসের অন্দরমহলে প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরার আস্থাভাজন হিসেবে দেখা হত।

    সেই ললিতেশপতি কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ যাদব সমাজবাদী পার্টির খাতা থেকে ভদোহী আসন ছেড়ে দিয়েছেন তৃণমূলকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সুসম্পর্কের খাতিরে। শুধু আসন ছেড়েই দেননি। অখিলেশের নেতৃত্বে গোটা সমাজবাদী পার্টি ভদোহীকে তৃণমূলের ললিতেশকে জেতাতে মাঠে নেমেছে। ললিতেশের প্রচারের পোস্টারে ইন্ডিয়া জোটের রামধনু। একই সারিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাহুল গান্ধী, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অখিলেশ যাদবের ছবি। মমতা-অভিষেক ভদোহীতে প্রচারে না গেলেও অখিলেশ ভদোহীর ভোটের আগে প্রচারে যাচ্ছেন। যদিও তৃণমূলে যোগ দেওয়া ললিতেশের জন্য কংগ্রেসের মধ্যে তেমন দরদ নেই।

    বারাণসীতে সাদা রঙের ‘ঔরঙ্গাবাদ হাউস’-এর বিরাট দালানের এক কোণে ঠাকুরঘর। পুরোহিত এসে সকালে নিত্য পুজো করে যান। দালানে বসে ললিতেশের খুড়তুতো ভাই তুষারপতি বলছিলেন, ‘‘কংগ্রেস ও তৃণমূল, মতাদর্শগত ভাবে খুব আলাদা নয়। কংগ্রেসের মতো তৃণমূলও ধর্মনিরপেক্ষ দল। ললিতেশ ভাইয়া কংগ্রেস ছাড়লেও মতাদর্শ ত্যাগ করেননি। অন্য অনেক কংগ্রেস নেতার মতো বিজেপিতে গিয়ে যোগ দেননি।’’

    কমলাপতির ‘ঔরঙ্গাবাদ হাউস’ অবশ্য পুরোপুরি বিজেপি-মুক্ত নেই। ললিতেশের কাকা সোমেশপতি ত্রিপাঠী বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। বাড়ির লোহার ফটকের পাশে বিজেপির ঝান্ডা ঝুলিয়ে নরেন্দ্র মোদীকে জেতানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। বাড়ির দোতলায় সোমেশপতির ঘরের জানলায় এখনও ‘জয় শ্রী রাম’ লেখা ঝান্ডা ওড়ে।

    ভদোহীতে ললিতেশপতির সামনেও এই ‘জয় শ্রী রাম’-এর চ্যালেঞ্জ। গত দশ বছর ভদোহী বিজেপির দখলে। এ বার বিজেপি পুরনো সাংসদ রমেশ বিন্দকে সরিয়ে বিনোদ কুমার বিন্দকে প্রার্থী করেছে। বিনোদ নিষাদ পার্টির নেতা। তবে বিজেপির প্রতীকে লড়ছেন। নিষাদ পার্টি ওরফে ‘নির্বল ইন্ডিয়ান শোষিত হমার আম দল’ মূলত মৎস্যজীবী ও মাঝি-মাল্লা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে। এই অনগ্রসর শ্রেণিভুক্ত সম্প্রদায়ের আরাধ্য দেবতা রামায়ণের নিষাদরাজ। যিনি রামায়ণে রামকে বনবাসের সময় নদী পার করিয়েছিলেন। নিষাদ পার্টির নেতা সঞ্জয় নিষাদের দাবি, প্রয়াগরাজের কাছে শ্রীঙ্গবেরপুরে নিষাদরাজের দুর্গে ‘বেআইনি’ মসজিদ রয়েছে। অযোধ্যার বাবরি মসজিদ, বারাণসীর জ্ঞানবাপীর মতো সেই মসজিদও সরাতে হবে।

    ললিতেশ প্রচারে বলেন, ‘‘বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য নিয়ে রাজনীতির লড়াই হওয়া উচিত।’’ তবে তাঁকেও জাতপাতের অঙ্ক কষতে হয়। ললিতেশের ভরসা ব্রাহ্মণ ভোট। তার সঙ্গে অখিলেশের মুসলিম ও যাদব ভোট। উল্টো দিকে, বিজেপি নিষাদ পার্টির নেতাকে প্রার্থী করে উচ্চবর্ণের পাশাপাশি অনগ্রসর ও দলিত ভোটব্যাঙ্ক ঝুলিতে টানতে চাইছে। খোদ নরেন্দ্র মোদী ভদোহীতে প্রচারে গিয়ে বলে এসেছেন, ‘বাবুয়া’ অখিলেশ যাদব এ বার উত্তরপ্রদেশের ‘বুয়া’ বা পিসি মায়াবতীর সঙ্গ ছেড়ে বাংলার ‘বুয়া’-র সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। বাংলার ‘বুয়া’ উত্তরপ্রদেশ-বিহারের লোককে বাংলায় বহিরাগত বলে কেন?

    ললিতেশের সামনে চ্যালেঞ্জ, উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে ‘বহিরাগত’ তৃণমূলের প্রতীকে ভোট টানা। তাঁর প্রচারে গান বাজে, ‘জয় কালী কলকাত্তাওয়ালি, দো ডালি, ছহ্ পত্তিওয়ালি!’
  • Link to this news (আনন্দবাজার)