মৌ রায়চৌধুরীর বর্ণময় জীবনের উদযাপনে অগণিত মানুষের শ্রদ্ধাঞ্জলি ...
আজকাল | ২৪ মে ২০২৪
আজকাল ওয়েবডেস্ক: শিল্পীর কন্ঠ হাহাকার হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। 'তবু মনে রেখো... '। মঞ্চে, দু' পাশে তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। মঞ্চের পর্দায় বড় বড় করে লেখা, 'আমার প্রিয় দুই সঙ্গী, গান আর বই' । ২৩ মে, মিলন মেলা প্রাঙ্গণ সাক্ষী থাকল মৌ রায়চৌধুরীর বর্ণময়, কর্মময় জীবনের উদযাপনের। উপস্থিত অগণিত মানুষ কেউ বলে, কেউ নীরব থেকে বোঝালেন, তাঁকে ছাড়া কী অসহনীয়, যন্ত্রণার এই জীবন। কথায়, গানে, কবিতায় তীব্র হল সেই যন্ত্রণা। আর সবকিছু যেন হাসিমুখে দেখলেন 'মৌ ম্যাডাম'। এভাবেই কাটল প্রায় চার ঘন্টা। একে একে উপস্থিত হলেন শিল্প, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, রাজনীতি সকল খাতের বিশিষ্ট জনেরা। প্রিয় 'মৌ'কে নিয়ে বলতে গিয়ে কারও গলা গেল বুজে। কেউ কাঁদলেন দিদির জন্য। কতশত স্মৃতি তাঁদের ঝুলিতে। কেউ বুঝিবা প্রশ্ন করলেন, 'কিসের এত তাড়া ছিল? ' কিশোরবেলার প্রেমিকা, সহধর্মিনী, কর্মজীবনের সঙ্গীকে হারিয়েছেন সত্যম রায়চৌধুরী। কী বলবেন! বলতে উঠলেন। কত কথা উঠে এল। বলতে বলতে গলা বুজে এল তাঁর। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় মনে করেন মৌ আছেন তাঁর সঙ্গে। ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর গলাতেও বিষাদ। তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না, 'মৌ' দি ছবিতে আটকে। গান-গল্প-সংস্কৃতির মূর্ত প্রতীক, বড়দিদিকে নিয়ে তাঁর মনে ভিড় করে আছে বহু কথা। এত স্নেহ, ভালবাসা কাদের কাছে পাবেন আর? গান গাইলেন, 'যে রাতে মোর দুয়ার গুলি ভাঙল ঝড়ে....' গার্গী রায়চৌধুরীর সঙ্গে কতবছরের আলাপ। দীঘল কালো চোখের মতো তাঁর গভীর হৃদয়ের কথা মনে পড়ছে সর্বক্ষণ। বললেন, 'তুমি আলো, তাই ভাল। ' বৃহস্পতিবার মৌ রায়চৌধুরীর স্মরণসভায় তাঁর প্রিয় গান, লেখালেখি, তাঁর বর্ণময় জীবনের নানাদিক উঠে এল বিভিন্ন স্তরের মানুষের কথায়। এই স্মরণসভা অন্য মাত্রা পেয়েছিল ছোটবেলা থেকে তাঁর গোটা জীবনের বিভিন্ন মুহূর্তের সাদাকালো ও রঙিন ছবির দৃশ্যায়নে। তিনি যেমন ভালবাসতেন রবীন্দ্রনাথের গান, ভালবাসতেন প্রকৃতিকে, তেমনই ভালবাসতেন তাঁর সঙ্গে যাঁরা কর্মসূত্রে, বন্ধুত্বে, ভালবাসায় জড়িয়ে ছিলেন। এদিনের স্মরণসভা প্রকৃত অর্থেই হয়ে উঠেছিল ‘অন্তরে অন্তরে হৃদয় জুড়ে’ এক বর্ণময় জীবনের উদ্যাপন, স্মতিচারণ। উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ, সিঙ্গাপুরের চেনা মানুষেরা। অনুষ্ঠানের শুরু বাঁশির অপূর্ব মূর্চ্ছনায় ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’ গানের মধ্যে দিয়ে। এরপর বেহালায় বেজে উঠল সুর। বেদমন্ত্র পাঠ করলেন স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত। প্রকাশিত হল স্মরণিকা 'রয়েছ নয়নে নয়নে'। স্বামী-পুত্রসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেই উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের প্রাক্তন সাংসদ ও আওয়ামি লিগের সাংস্কৃতিক সেলের সম্পাদক অসীম উকিল ওতাঁর স্ত্রী অপু উকিল, স্বামী বিশ্বাত্মানন্দ মহারাজ, সাহিত্যিক প্রচেত গুপ্ত, সাংবাদিক দেবাশিস দত্ত প্রমুখ। একে একে এলেন মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন, সাংসদ দোলা সেন, মন্ত্রী বেচারাম মান্না,বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু, কাউন্সিলর অনন্যা ব্যানার্জি, তৃণমূল প্রার্থী রচনা ব্যানার্জি। মঞ্চে গানে কথায় স্মরণ করলেন ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়, অরিন্দম শীল, সুবোধ সরকার, গার্গী রায়চৌধুরী, সুধাংশুশেখর দে, ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়, অমিতা দত্ত, ধ্রুবজ্যোতি চট্টোপাধ্যায়, জয়প্রকাশ মজুমদার, সৈকত মিত্র, জয়তী চক্রবর্তী, তথাগত সেনগুপ্ত, মনোজ মুরলী, শোভনসুন্দর বসু প্রমুখ। রায়া ভট্টাচার্য এই স্মরণসভার যেন সুর বেঁধে দিলেন, বললেন— রবীন্দ্রনাথ তাঁর অন্তরের মানুষ। এই প্রাণশক্তি, এই জীবনশক্তি তিনি কোথা থেকে পেতেন? এ এক বিস্ময় আমার কাছে। মৌ রায়চৌধুরি ছিলেন টেকনো ইন্ডিয়া গ্রুপের কো–চেয়ারপার্সন, সিস্টার নিবেদিতা ইউনিভার্সিটির গভর্নিংবডির সদস্য, আজকাল পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেডের ডিরেক্টর, আজকাল ডট ইন পোর্টালের প্রধান সম্পাদক। বিশ্ববাংলা মেলা প্রাঙ্গণে এই স্মরণসভায় কবি সুবোধ সরকার মৌ রায়চৌধুরীকে নিয়ে লেখা একটি কবিতা পাঠ করলেন। মৌ রায়চৌধুরির স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন সিঙ্গাপুর থেকে শ্রীদেব মুখার্জি, উত্তরবঙ্গর শিলিগুড়ি থেকে, চুঁচুড়া বইমেলা কমিটির পক্ষ থেকে, ব্যারাকপুর টেকনো গ্লোবাল হসপিটাল থেকে প্রতিনিধিরা। একে একে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন পবিত্র সরকার, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রণতি ঠাকুর, শুভা প্রসন্ন, দেবাশীষ কুমার, জয়দীপ মুখার্জি, দেবাশিস সেন, অত্রি ভট্টাচার্য, সুরঞ্জন দাস, ওমপ্রকাশ মিশ্র, চলচ্চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ, চিত্রা লাহিড়ী, অভিনেতা ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়, গায়ক দেবজ্যোতি মিশ্র, শোভন গাঙ্গুলি।এদিন তাঁর স্মরণে গৌতম ঘোষ বলেন, আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে না, ও নেই। ২০ বছর আগে বিদেশে আলাপ। তারপর বিভিন্ন কাজের মধ্যে দিয়ে আমাদের পরিচয় আরও সুদৃঢ় হয়েছে। শুভা প্রসন্ন ভাষণে বলেন, একটা ফুল সুগন্ধ নিয়ে এসেছিল। একটা ঝড়ে পড়ে গেল। সে বড় আপনার ছিল। প্রচেত গুপ্ত বলেন, ‘আজকালের জন্য যে দরদ, নিষ্ঠা এবং ভালবাসা দিয়েছিলেন, তা চিরদিন থাকবে’। স্মতিচারণা করেন অভিনেতা সাহেব চট্টোপাধ্যায়। বিষন্ন বাবুল সুপ্রিয়, মনে রাখতে চান 'মৌ' দির হাসিমুখ। এদিন একটি অডিও ভিস্যুয়ালে মৌ রায়চৌধুরির জীবনের নানা দিক, তাঁর শৈশব থেকে কর্মজীবনের নানা অংশ দেখানো হয়। পরিবারের প্রিয়জনেরা গাইলেন 'আমার মল্লিকাবনে...'। তাঁকে ফোন করলে এই গানই বেজে উঠত যে। অনুষ্ঠান শেষ হল মৌ রায়চৌধুরীর প্রিয় গান, 'আগুনের পরশমণি' দিয়ে। সকলের চোখে জল তখন, মনে মৌ রায়চৌধুরীর স্মৃতি। এই অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সাংবাদিক গৌতম ভট্টাচার্য ও ঐন্দ্রিলা মুখার্জি।