আগুন জ্বলেছে হত্যাকাণ্ডের পর! নন্দীগ্রামের সেই গঞ্জে এখন ‘শ্মশানের নিস্তব্ধতা’, ভোট হবে তো? উঠছে প্রশ্ন
আনন্দবাজার | ২৫ মে ২০২৪
গড়চক্রবেড়িয়া থেকে সোনাচূড়ার পথে ঢুকে সাউথখালির দিকে এগোলেই পর পর দোকানের শাটার নামানো। বেলা ১২টাতেও কোনও দোকানের তালা খোলেনি। জমজমাট বাজার এলাকাও একেবারে জনশূন্য! গোটা রাস্তা বিজেপির পদ্মপতাকায় মোড়া থাকলেও, সব সময়ে ভিড়ে ঠাসা থাকা পার্টি অফিসেও লোকজন নেই। যেন অঘোষিত বন্ধ চলছে! শ্মশানের নিস্তব্ধতা বললেও অত্যুক্তি হয় না। ফাঁকা রাস্তায় ঘুরছে শুধু পুলিশের গাড়ি। আর কয়েকটি জায়গায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের জটলা! শুক্রবার সকাল থেকে সাউথখালির ছোট্ট গঞ্জ মনসাবাজারে ঠিক এই ছবিই দেখা গেল।
গত বুধবার রাতে বিজেপির মহিলা কর্মী রথিবালা আড়িকে কুপিয়ে খুনের ঘটনায় এই মনসা বাজার রাতারাতিই সংবাদের শিরোনামে উঠে এসেছে। ষষ্ঠ দফার ভোটযুদ্ধে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে নন্দীগ্রামের মানচিত্রের এই অখ্যাত এলাকাটি। নন্দীগ্রাম-খেজুরি যাওয়ার রাস্তার পাশে এই বাজারে ৮০-৮৫টি দোকান রয়েছে। এলাকাটি বেশ জমজমাট। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সেই বাজারে তাণ্ডব চালিয়েছে উন্মত্ত জনতা। অভিযোগ, বেছে বেছে তৃণমূল সমর্থকদের দোকান বুলডোজ়ার এনে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। জ্বালিয়েও দেওয়া হয়েছে কিছু দোকান। সেই সব দোকানের আশপাশে পড়ে রয়েছে পোড়া কাগজপত্র।
স্থানীয় সূত্রে খবর, শুধু দোকানঘর ভাঙচুর করেই ক্ষান্ত থাকেননি বিজেপির কর্মী-সমর্থকেরা। এলাকার কিছু তৃণমূল নেতার বাড়িতেও হামলা-ভাঙচুর চালানো হয়েছে। সময় যত এগিয়েছে, অশান্তি ছড়িয়েছে গোটা সোনাচূড়া জুড়ে। তার পর থেকে স্থানীয় তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের প্রায় সকলেই ঘরছাড়া! এই পরিস্থিতিতে শনিবার সোনাচূড়া ভোট কতটা নির্বিঘ্নে হবে, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। মনসা বাজারের এক মহিলা বলেন, ‘‘খুব খারাপ অবস্থা এখানে। পুলিশ, বাহিনী থাকলেও নিরাপত্তা একেবারেই নেই। এ বার হয়তো ভোট দিতেই যাওয়া হবে না।’’
ঘরছাড়া হওয়া সুবল মণ্ডল জানান, তাঁর পরিবারের দুই সদস্য ভরত মণ্ডল আর পুষ্পেন্দু মণ্ডল ২০০৭ সালে জমি আন্দোলনে শহিদ হয়েছিল। পুষ্পেন্দু তাঁর তুতো ভাই। সেই পরিবারের ছেলে হয়ে এত দিন নিজে তৃণমূল করেছেন। বৃহস্পতিবার তাঁর বাড়িতে হামলা হয়। সুবলের প্রশ্ন, মনসা বাজার থেকে তাঁর বাড়ি বহু দূরে হওয়া সত্ত্বেও কেন হামলা হল? সুবল সোনাচূড়ার গাংড়ার বাসিন্দা। ঘরছাড়া হয়ে আপাতত নিরাপদ আশ্রয়েই রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘বিজেপির শয়ে শয়ে লোক শাবল, রড নিয়ে হামলা চালাল। আমাকে প্রাণে মারার চেষ্টা করল। পরে পুলিশের সহায়তায় কোনও ক্রমে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি।’’
যদিও পুলিশ সূত্রে খবর, ভোটের দিন নন্দীগ্রামের আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। নন্দীগ্রাম-খেজুরির সীমানা এলাকা, গোকুলনগরের তেখালি সেতু ও সোনাচূড়ার ভাঙাবেড়ার কাছে বসানো হয়েছে নাকা চেকিং। ওই এলাকায় যাওয়া-আসা করা প্রতিটি গাড়ি, বাইকে খুঁটিয়ে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। পর্যাপ্ত কেন্দ্রীয় মোতায়েন করা হয়েছে। হিংসাবিধ্বস্ত এলাকা ঘুরেছেন জেলা পুলিশ সুপার সৌম্যদীপ ভট্টাচার্য। কেন্দ্রীয় বাহিনী ও পুলিশ আধিকারিকেরা আশ্বস্তও করছেন স্থানীয় বাসিন্দাদের।
শুধু তৃণমূল সমর্থকেরাই নন, বৃহস্পতি ও শুক্রবারের তাণ্ডবের পর অনেক বিজেপি সমর্থকও ঘরছাড়া পুলিশি ধরপাকড়ের ভয়ে। বিজেপির দাবি, ইতিমধ্যেই দলের এক কর্মীকে আটক করা হয়েছে। তবে বিজেপি নেতা মেঘনাদ পাল বলেন, ‘‘আমাদের দলের কেউ কারও উপর হামলা চালায়নি। গ্রামবাসীরাই এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। আমাদের দলীয় কর্মীকে প্রকাশ্যে খুন করা হল। অথচ সেই অপরাধীরা চোখের সামনে ঘুরলেও পুলিশ নীরব। এ দিকে তারা বেছে বেছে বিজেপির লোকজনকে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতার করছে। এর বিরুদ্ধে মানুষ ভোটবাক্সে জবাব দেবে।’’
পাল্টা তৃণমূল নেতা শেখ সুফিয়ান বলেন, ‘‘বিজেপির কোন্দলেই প্রাণ গিয়েছে মহিলা কর্মীর। ভোটের মুখে এই ঘটনাকে হাতিয়ার করেই গোটা সোনাচূড়া এলাকা থেকে তৃণমূলের লোকেদের ঘরছাড়া করা হচ্ছে। আমরা পুলিশকে বিষয়টি জানিয়েছি। আইন মেনে পুলিশ উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে বলেই আমরা আশা করছি।’’