ব্যাটারি-চিন্তার মুশকিলআসান তিন বাঙালি বিজ্ঞানীর গবেষণা
আনন্দবাজার | ২৫ মে ২০২৪
ছুটতে ছুটতেও ছুটে চলেছে মানুষ। তার আধখানা মুহ্যমান হয়ে পড়ে মোবাইল ফোনের ব্যাটারি ফুরোলে। এ দিকে চার্জ দিতে গিয়ে বাঁধা পড়তে হয় তারে। নয়তো হাতছাড়া করতে হয় ফোন— কেজো দরকারেই হোক বা অভ্যাসের খাতিরে, যেটা অঙ্গহানিরই শামিল। চার্জের জমা-খরচের ব্যাপারে কী ভাবে ব্যাটারি হয়ে উঠতে পারে আরও চটপটে ও চালাক-চতুর, তিন বাঙালি বিজ্ঞানী তার পথ দেখিয়েছেন। এখনকার অধিকাংশ ইলেকট্রনিক যন্ত্রে যে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়, তাঁদের আবিষ্কৃত পদ্ধতিতে তা অর্ধেক সময়ে পুরো চার্জ নিয়ে ফেলতে পারবে। আর খরচ করবে ধীরে, প্রায় দ্বিগুণ সময় ধরে।
ইলাহাবাদের হরিশচন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী দম্পতি সুদীপ চক্রবর্তী ও তিষিতা দাস এবং আমেরিকার টেক্সাস এ অ্যান্ড এম ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী অধ্যাপক সর্বজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘নেচার মেটেরিয়ালস’ জার্নালে প্রকাশিত তাঁদের গবেষণাপত্রে ‘প্রি ইন্টারকালেশন’ নামে নতুন পদ্ধতির কথা বলেছেন। এই রসায়নে একটি ব্যাটারি তৈরিও করেছেন সর্বজিতেরা। গত এক দশক ধরে ক্রমেই উন্নততর হয়েছে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির প্রযুক্তি। তবে এই ‘প্রি ইন্টারকালেশন’ পদ্ধতি মোবাইল, ল্যাপটপ থেকে শুরু করে বিদ্যুৎচালিত পরিবহণেরও ভোল পাল্টে দেবে বলে তাঁরা আশাবাদী।
যন্ত্রে চালিকাশক্তি যোগানোর সময় ব্যাটারির অ্যানোড অংশ থেকে লিথিয়ামের আয়ন ক্যাথোড অংশে যেতে থাকে। অ্যানোডের গ্রাফাইটে লিথিয়াম একা একা থাকে, যা মোটেও তার ধর্ম নয়। ক্যাথোডে কোবাল্টের মতো ধাতুর অক্সাইডের সঙ্গে জুড়তে চেয়ে লিথিয়াম পরমাণু নিজের একটা ইলেকট্রন ছেড়ে দু’টি আয়নে ভাঙে। ধাতব তার দিয়ে ক্যাথোডে পৌঁছনোর পথে ঋণাত্মক আয়ন, অর্থাৎ দলছুট ইলেকট্রনগুলিকে সার্কিট থেকে সার্কিটে ছুটিয়ে ইলেকট্রনিক যন্ত্র কাজ করায়। ব্যাটারির ভিতরে চার্জের ভারসাম্য বজায় রাখতে ধনাত্মক আয়ন অর্থাৎ ইলেকট্রন ঝেড়ে ফেলা পরমাণুর বাকি অংশ লিথিয়াম-লবণের দ্রবণের মধ্য দিয়ে ক্যাথোডে পৌঁছয়।
হরিশচন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রিডার ও ‘মেটস ল্যাব’-এর প্রধান সুদীপ এবং ‘ইন্সপায়ার ফ্যাকাল্টি’ তিষিতা জানান, লিথিয়াম আয়নগুলি ব্যাটারিতে চার্জ দেওয়ার সময় নিজের নিজের পথে আবার অ্যানোডে ফিরে যায়। তাকেই বলে ‘ইন্টারকালেশন’। ক্যাথোডের ধাতব অক্সাইডের সঙ্গে দু’দিক দিয়ে আসা লিথিয়ামের দুই আয়ন আলাদা ভাবে জুড়ে নতুন যৌগ গঠন করে থাকে। তার আণবিক বন্ধন শক্তপোক্ত। চট করে ভাঙতে চায় না।
বাঙালি বিজ্ঞানী ত্রয়ী জানাচ্ছেন, তাঁরা কোবাল্ট অক্সাইডের বদলে ক্যাথোডে ভ্যানাডিয়াম পেন্টক্সাইড নামে একটি রাসায়নিক যৌগের সঙ্গে সোডিয়াম ও পটাশিয়াম ব্যবহার করে দেখেছেন, লিথিয়ামের ধনাত্মক আয়নগুলি এসে সুবিন্যস্ত ভাবে তার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। তার মধ্যে সোডিয়াম ও লিথিয়াম পরমাণুর বিন্যাসে একটি নির্দিষ্ট ছাঁচ লক্ষ করা যাচ্ছে। লিথিয়াম ও সোডিয়াম পরমাণু বহুমাত্রিক নকশায় সমান্তরাল ভাবে বসছে। গবেষণাপত্রে এই অতিসূক্ষ্ম পথবিন্যাসের খুঁটিনাটি রয়েছে। একেই প্রি-ইন্টারকালেশন বলেছেন তাঁরা। এ ভাবে ক্যাথোডে বেশি আয়ন ধরানো যায়, আবার ঝাঁক ধরে ফেরতও পাঠানো যায় বলে ব্যাটারির স্বাস্থ্যও ভাল থাকে।
তারকেশ্বরের মন্দিরপাড়ার সুদীপ নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাক্তনী। দমদমের তিষিতা এক সময়ে গবেষণা করেছেন যাদবপুরের ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্সে। সর্বজিৎ আদতে দক্ষিণ কলতাকার কসবার বাসিন্দা। সম্প্রতি লাদাখের রেয়াসি জেলায় দেশের মধ্যে প্রথম খোঁজ মিলেছে লিথিয়ামের ভান্ডারের। তিন বাঙালি বিজ্ঞানীর আশা, সেই সঞ্চয় কাজে লাগিয়ে উন্নতির পথে দেশকে আরও দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাবে তাঁদের গবেষণা।