• সংগঠনেই ভরসা নিয়তিবাদী সৌগতর, কী বলছেন সুজন-শীলভদ্ররা?
    প্রতিদিন | ২৭ মে ২০২৪
  • ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়: ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে দমদমের ভোটগণনা শেষ হওয়ার মুখে কিছু সময়ের জন‌্য মনে হয়েছিল এই কেন্দ্র বোধহয় তৃণমূলের হাতছাড়া হচ্ছে বিজেপির কাছে। সামান‌্য উচাটনের সে হিসাব ভুল ছিল। ৫৩ হাজার ভোটে জিতেছিলেন বর্ষীয়ান প্রফেসর সৌগত রায়। এবারের হিসাব যা-ই হোক, ভোটের বাজার জমিয়ে তুলেছেন সিপিএমের সুজন চক্রবর্তী। কেউ বলছে, দমদম কেন্দ্রের লড়াই ত্রিমুখী। কারও দাবি, তৃণমূল জয়ের কাছেই রয়েছে, লড়াই সিপিএম-বিজেপিতে। তাও যাদবপুরের প্রাক্তন সাংসদ সুজন দমদমের প্রার্থী হওয়ায় ভোটের আঁচ গায়ে লাগছে। তা না হলে ঠান্ডা লড়াই হত।

    সুজনের নাম দমদম লোকসভা কেন্দ্রে ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এলাকায় সিপিএমের পুরনো কর্মী, সমর্থকরা চাঙ্গা। ২০১৯-এ নেপালদেব ভট্টাচার্যের মিছিলে যা ভিড় হয়েছিল, এবার তা বহরে বেড়েছে। এবার কংগ্রেসও সঙ্গে। এই কেন্দ্র নিয়েই অবশ‌্য আসন সমঝোতা চলাকালীন এবার সিপিএম-কংগ্রেসে কয়েক দফায় ঠান্ডা লড়াই হয়ে গিয়েছে এই আসন কে নেবে সেই তর্কে। সিপিএমের  (CPM) দাবি ছিল, দমদম প্রাক্তন মুখ‌্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর আসন, তাই ঐতিহ্যের। সেটা তাই তাদেরই পাওয়ার কথা। কংগ্রেস কর্মীদের বক্তব‌্য ছিল, সিপিএম কবে ঘি খেয়েছিল, এখনও গন্ধ শুঁকছে!

    প্রদেশ সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরী এলাকার কর্মীদের দাবি না শোনায় এআইসিসি পর্যন্ত চিঠি খেয়েছে। শেষে খেলাটা নাকি ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন সিপিএম রাজ‌্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। শোনা গিয়েছিল, সুজন চক্রবর্তী যাদবপুর আসনের বড় দাবিদার ছিলেন। কংগ্রেস শিবিরের বিশ্বাস, এক ঢিলে দুই পাখি মেরে দেন সেলিম। কলকাতার রাজনীতি থেকে সুজনকে সরিয়ে দিয়ে। সঙ্গে দলের ছোটদের মধ্যে জনপ্রিয় হতে যাদবপুরে নতুন মুখ আনেন। দলীয় রাজনীতি যা-ই হোক, দমদমে সিপিএমের মরা গাঙে জোয়ার এনে দিয়েছেন সুজন। বয়স্ক সুজনের ?ক্রেজ? আছে নানা বয়সের মধ্যে। অল্প বয়সিদের মধ্যে তাঁর আকর্ষণ ছোট ছোট কথায় ‘সুজন’ হওয়ার গুণে। বেশি বয়সিদের ক্ষেত্রে চট করে তাঁদের সঙ্গী হওয়ার জোরে। আর তিন, মাথাভরা সাদা চুলের মানুষ হলেও সুজন এমন এক ব‌্যক্তিত্ব, যিনি রাশভারী নেপালদেবের তুলনায় নেক্সট জেনারেশন প্রার্থী। সঙ্গে হাসিমুখ, তরতাজা, চটপটে।

    চব্বিশের নির্বাচনে দমদমে কোন কোন ইস্যুতে তৃণমূলকে দুষছেন? “কোন ইস্যুর কথা বলব? বরানগর, কামারহাটি, পানিহাটির নিয়োগ দুর্নীতি। পানিহাটিতে পানীয় জলের সমস‌্যা। বেআইনি নির্মাণ। আর জঞ্জাল নিয়ে তো মানুষ নাজেহাল” – জবাব সুজনের। তৃণমূল বলছে, নিয়োগ নিয়ে অভিযোগ সবই তৃণমূলকে ছোট করার জন‌্য। শুধু অভিযোগই উঠেছে। কোনও ফল সামনে আসেনি। ভোটেও প্রভাব নেই। “পড়েছে, কে বলেছে পড়ছে না?” – প্রশ্নটা ছুঁড়লেন বিজেপির প্রার্থী শীলভদ্র দত্ত। তাঁর সাফ কথা, “দমদম এবার বদলাবে। মানুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে জবাব দেবে। তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে খবর আছে যে, পরিস্থিতি ভালো না।”

    দমদমকে বদলাতে হলে এই মুহূর্তে সেখানকার রাজনৈতিক যা পরিস্থিতি তাতে গতবারের বিজেপির সাড়ে চার লক্ষ আর সিপিএমের এক লক্ষ ৬০ হাজার ভোট মিলিয়ে কমপক্ষে ছয় লক্ষ ভোটের পরও আরও ৫০ হাজার ভোট টানতে হবে সিপিএমকে। তবেই তৃণমূলের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলতে পারে সিপিএম। এলাকায় পুরনো কথাটা আবার ঘুরতে শুরু করে সুজনের নাম ঘোষণার পরপরই। রামের চলে যাওয়া ভোট কি বামে ফিরবে? আর যদি ফেরেও তাতে কি সিপিএম জিতবে? নাকি তৃণমূল-বিরোধী সমস্ত ভোট কেটে সহজ জয় হবে তৃণমূলের? দলের স্ট্র‌্যাটেজি সুজন প্রকাশ্যে না বললেও যা বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাতে এবার রামে চলে যাওয়া ভোট বামে ফিরছেই। সিপিএম প্রার্থীর সংযোজন, “এবার নতুন ভোটার অনেক বেড়েছে। দলের পুরনো কর্মীরাও দারুণ চাঙ্গা। কোথাও কেউ আর ঘরে বসে নেই।” উলটোদিকে বিজেপি প্রার্থী শীলভদ্রর দাবি, “বামের ভোট আগেরবার রামে তো আসেইনি। ফিরবে কী?” সঙ্গে সুজনকে তাঁর কটাক্ষ, “তিনি আবার এমন হেভিওয়েট যে, যাদবপুর থেকে দমদমে চলে এলেন। আর কেন এলেন, কে তাঁকে পাঠাল, সে দমদমের সিপিএম কর্মীরা জানেন। সুজনবাবু তো এসেছেন ভোট কাটতে।” শীলভদ্রের দাবি, সে গুড়ে বালি।

    এসব হিসাবের কথা শুনে মৃদু হাসলেন প্রফেসর। বললেন, “আমি ফেটালিস্ট (নিয়তিবাদী), যা হওয়ার হবে। রাজনীতির হিসাবে আমি যাব না। ভোট ঘোষণা হওয়ার আগে পর্যন্ত আমি দমদমের জন‌্য কাজ করেছি। তার ভিত্তিতে আবার ভোট চাইতে এসেছি।” দমদমের সাত কেন্দ্রের মধ্যে ছজন তৃণমূলের বিধায়ক। বরানগর বিধানসভা কেন্দ্র তৃণমূলের জেতা। ৯টা পুরসভার সবটাই তৃণমূলের দখলে। ১৫ বছরের সাংসদের মূল শক্তি সংগঠনের এই সবুজ গালিচার মোটা পরত। তাঁর কথায়, “সিপিএম, বিজেপি নিয়ে আমি বেশি চিন্তা করছি না। ওরা শুধু খবরে আছে। আমি মানুষের মধ্যে আছি। আর মানুষ মনস্থির করে ফেলেছে। তারা কমিটেড।” দলের মধ্যে পুরসভাভিত্তিক যেসব দ্বন্দ্ব সামনে এসেছিল, সেসব মাথাচাড়া দিয়ে ভোটে প্রভাব ফেলতে পারবে না বলেই তাঁর দাবি। অন‌্যদিকে, পানিহাটি পুরসভার সমস‌্যাকে গুরুত্ব দিয়েই তাঁর মত, “সমস‌্যা থাকবে। সেসবের সমাধানেরও চেষ্টা চলছে। মানুষ বাস্তবটা বোঝেন। তাঁরা আমাদের সঙ্গেই আছেন।”

    অন‌্যদিকে, ‘রামের ভোট বামে ফেরা’ নিয়ে তৃণমূল প্রার্থীর বক্তব‌্য খুব স্পষ্ট। বলছেন, “আগেরবার পরিকল্পনা করে বামের ভোট রামে ট্রান্সফার হয়েছিল। সেটা এবার সুজন আটকাবে। বিরোধীরা প্রার্থী দিয়েছে, প্রচার করছে। এর বেশি ভাবছি না।” তবে নিজের প্রচারের বাইরেও সিপিএম-বিজেপির প্রচারেও নজর রেখেছেন সৌগত। বিজেপিকে গুরুত্ব দিতে না চাইলেও সিপিএম নিয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ, “যাদবপুর থেকে ওদের প্রার্থীকে এসে দমদমে প্রচার করতে হচ্ছে। কিন্তু সুজন গভীরে যেতে পারেনি।”
  • Link to this news (প্রতিদিন)