১৭ এপ্রিল, রাত প্রায় ১২টা। কিছু ক্ষণ আগেই আইপিএলের ইতিহাসে সবচেয়ে লজ্জার হার হেরেছে তাঁর দল। ২৬১ রান করেও প্রতিপক্ষকে আটকাতে পারেনি কলকাতা নাইট রাইডার্স। তা-ও আবার ঘরের মাঠে। দলের ক্রিকেটারেরা হতাশ। মাঠের মধ্যে ছড়িয়ে, ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে তাঁরা। হঠাৎ, তিনি এলেন। না, নিজের দলের ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথা বললেন না। আগে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন বিপক্ষ দলের ব্যাটার জস বাটলারকে, যাঁর শতরানে হেরেছে তাঁরই দল। তার পর একে একে সবার সঙ্গে কথা। মাঠে, তার পরে সাজঘরে। কোনও বকা-ঝকা নয়। বড় দাদার মতো পিঠ চাপড়ে বলা, “চিন্তা নেই। মন খারাপ করো না। পরের ম্যাচেই তোমরা জিতবে। এটাই ক্রিকেট।” এটাই হয়তো জীবনও। সাফল্য-ব্যর্থতা সেখানে পরতে পরতে থাকে। তিনি নিজের জীবন ও ৩০ বছরের কেরিয়ারে সেটা বার বার দেখেছেন। সেই মন্ত্রই শিখিয়েছেন দলকে। কেকেআর ক্রিকেটারেরাও হয়তো সেই মন্ত্র নিয়েই খেলেছেন। জিতেছেন। চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। তাই এ বারের আইপিএলে সত্যিকারের ‘বাজ়িগর’ তিনিই। শাহরুখ খান।
এ বারের আইপিএল দেখিয়েছে মালিকদের বিভিন্ন চরিত্র। পঞ্জাব কিংসের মালকিন প্রীতি জ়িন্টা যেমন বেশির ভাগ ম্যাচে মাঠে থেকেছেন শুধু পতাকা নাড়ার জন্য। দলে বিশেষ নাক গলাননি। ম্যাচ শেষে মাঠে নেমে কিছু ক্রিকেটারের সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু সাজঘরে দেখা যায়নি তাঁকে। আবার লখনউ সুপার জায়ান্টসের মালিক সঞ্জীব গোয়েন্কা ম্যাচ হেরে প্রকাশ্যে মাঠেই অধিনায়ক লোকেশ রাহুলকে ভর্ৎসনা করেছেন। সেই ঘটনা নিয়ে বিতর্ক হওয়ায় তড়িঘড়ি সেই রাহুলকেই নৈশভোজে ডেকেছেন। এই বিতর্কের প্রভাব দলে পড়েছে। প্লে-অফে ওঠার আগেই বিদায় নিয়েছে লখনউ। সেখানে শাহরুখ বাকি সবার থেকে আলাদা। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, এক জন মালিকের কাজ ঠিক কী?
কয়েক বছর আগেও দলের সিদ্ধান্তে নাক গলাতেন শাহরুখ। কাদের নেওয়া হবে, কারা কেমন খেলছে, সেই সব নিয়ে কোচের সঙ্গে কথা বলতেন। কিন্তু ১৬ বছরের আইপিএল তাঁকে শিখিয়েছে, এতে দলের ক্ষতি বই লাভ হয় না। তাই এ বার নতুন ভূমিকায় দেখা গিয়েছে তাঁকে। শাহরুখ জানেন, আত্মবিশ্বাস সাফল্যের মূল চাবি। সেটাই তিনি ক্রিকেটারদের বার বার দিয়েছেন। এ বার বেশির ভাগ ম্যাচে তিনি মাঠে এসেছেন। এর আগে এত ম্যাচে শাহরুখকে দেখা যায়নি। খেলার আগে নয়, খেলা শেষে ক্রিকেটারদের সঙ্গে দেখা করেছেন। দল হারলে কাউকে আলাদা করে দোষ দেননি। উল্টে কাঁধে হাত রেখেছেন। জিতলে ক্রিকেটারদের থেকে বেশি আনন্দ করেছেন। মাঠে নেমেছেন। দর্শকদের মনোরঞ্জন করেছেন। সব মিলিয়ে যেন এক সুপারহিট হিন্দি ছবির প্যাকেজ। শাহরুখ এ বার নিজে শুধু ভরসা দিয়েছেন। বিনোদন দিয়েছেন। বাকিটা ছেড়ে দিয়েছেন ম্যানেজমেন্টের উপর।
আইপিএলের দু’মাস নয়, কেকেআরের সাফল্যের নীল নকশা অনেক আগেই শুরু করে দিয়েছিলেন শাহরুখ। মেন্টর করে নিয়ে আসেন গৌতম গম্ভীরকে। শাহরুখ জানতেন, চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত ঘরোয়া ক্রিকেটে যত বড় কোচই হন না কেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদের সামলাতে আন্তর্জাতিক তারকা দরকার। আর সেই কাজের জন্য গম্ভীরের থেকে ভাল কেউ নেই। যে দলকে অধিনায়ক হিসাবে দু’বার চ্যাম্পিয়ন করেছেন, মেন্টর হিসাবেও সেই দলকে চ্যাম্পিয়ন করতে গম্ভীর যে জান লড়িয়ে দেবেন তা শাহরুখ জানতেন। গম্ভীরকে আনার নেপথ্যে আরও একটি কারণ কাজ করেছিল। গত কয়েক বছরে বার বার প্লে-অফে না উঠতে পারা কেকেআর থেকে কিছুটা হলেও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন সমর্থকেরা। গম্ভীর আসায় ফেরেন সেই সমর্থকেরাও। চলতি আইপিএলে ঘরের মাঠে কেকেআর যে সমর্থন পেয়েছে তারই প্রমাণ। আর দর্শকদের সেই সমর্থন কাজে লাগিয়ে ঘরের মাঠে সাতটি ম্যাচের মধ্যে পাঁচটি জিতেছে কেকেআর। যা বাকি সব দলের থেকে বেশি।
শাহরুখকে এ বার অনেক কাছ থেকে পেয়েছেন ক্রিকেটারেরা। বরুণ চক্রবর্তী বলেছেন, “এই বছরই আমি শাহরুখ স্যরের সঙ্গে প্রথম বার দেখা করতে পেরেছি। এ বার তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে কোনও সমস্যা হচ্ছে না। যে চাইছে তাঁর সঙ্গেই উনি কথা বলছে। পঞ্জাবের কাছে হারের পরে এক ঘণ্টা ধরে সবার সঙ্গে আলাদা আলাদা করে কথা বলেছেন শাহরুখ স্যর। সবাইকে ভরসা দিয়েছেন। ওঁর মতো মালিক কেউ নেই।” একই কথা শোনা গিয়েছে মেন্টর গম্ভীরের গলাতেও। শাহরুখ এই দলটার সঙ্গে কতটা জড়িয়ে সেটা জানিয়েছেন তিনি। শাহরুখকে কাছে পেয়ে ক্রিকেটারেরাও যে ফুরফুরে মেজাজে খেলেছেন তা স্বীকার করে নিয়েছেন দলের মেন্টর।
কেরিয়ারে সাফল্য শাহরুখকে কেউ প্লেটে তুলে দেয়নি। প্রতিটা ইঞ্চির জন্য লড়তে হয়েছে। বলিউডের ‘বাদশা’ হওয়ার জন্য অনেক ঘাম-রক্ত ঝরিয়েছেন শাহরুখ। জীবন তাঁকে শিখিয়েছে, এক দিনে সফল হওয়া যায় না। তার জন্য লাগে সময়। লাগে প্রসেস। লাগে ধৈর্য। লাগে জেতার খিদে। লাগে জান লড়িয়ে দেওয়ার তাগিদ। এই সবই তিনি কেকেআরের ক্রিকেটারদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন। সেই কারণেই, গ্রুপ পর্বে ব্যর্থ মিচেল স্টার্ক, শ্রেয়স আয়ারেরা প্লে-অফে ভাল খেলেছেন। সেই কারণেই, ‘বুড়ো’ সুনীল নারাইন, আন্দ্রে রাসেলরা দেখিয়েছেন, এখনও তাঁদের মধ্যে কতটা খেলা বাকি। এ বারের আইপিএলে দলগত ক্রিকেট খেলেছে কেকেআর। তার নেপথ্যে কিছুটা হলেও অবদান রয়েছে শাহরুখের।
তারকা সন্তান না হওয়ায় কেরিয়ারের শুরুতে নায়কের চরিত্রে সুযোগ পেতে সমস্যা হয়েছে শাহরুখের। সংসার চালাতে অন্যের ছেড়ে দেওয়া ছবিতে অভিনয় করতে হয়েছে তাঁকে। নায়কের চরিত্র না পেয়ে খলনায়ক হয়েছেন। তাতেই কামাল করেছেন তিনি। শাহরুখ বুঝেছেন, তারকা কী ভাবে হতে হয়। যে ভাবে একটা ছবি সুপারহিট হওয়ার নেপথ্যে অভিনেতা, অভিনেত্রীর পাশাপাশি চিত্রনাট্য, সংলাপ, গান, পরিচালনা সব দরকার, যে ভাবে ভাল রান্নার জন্য প্রয়োজন সব রকমের মশলা, ঠিক সে ভাবেই একটা দল সফল হতে গেলে লাগে দলগত খেলা। যত ক্ষণ না কোনও দলের সবাই একই লক্ষ্যে খেলছে তত ক্ষণ সাফল্য আসবে না। শাহরুখের পাশাপাশি সেটা ভাল ভাবে জানেন গম্ভীরও। দু’জনে মিলে তাই এমন একটি দল গড়েছেন যেখানে তারকার সমাহার নেই। আইপিএলের সব দলের দিকে তাকালে দেখা যাবে, সব থেকে কম তারকা রয়েছে কেকেআরে। সেই কারণেই এই দলে ইগোর সমস্যা হয়নি। সবাই একসঙ্গে মজা করে খেলেছেন। এক জনের সাফল্যে অন্যেরা আনন্দ করেছেন। সেটাই বদলে দিয়েছে দলকে।
নিজের সিনেমার সংলাপকে বাস্তবে পরিণত করেছেন শাহরুখ। ‘ওম শান্তি ওম’ ছবিতে তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছিল, “অগর কিসি চিজ় কো দিল সে চাহো তো পুরি কায়নাত উসে তুমসে মিলানে কি কোশিস মে লগ জাতি হে।” যার বাংলা মানে, যদি কিছু পাওয়ার চেষ্টা মন থেকে করো তা হলে তুমি পাশে পুরো দুনিয়াকে পাবে। সেই ছবিতেই শাহরুখের চরিত্রকে বলতে শোনা গিয়েছিল, “হামারি ফিলমো কি তরহ্, হামারি জিন্দেগি মে ভি এন্ড তক সব কুছ ঠিক হো যাতা হ্যায়। হ্যাপি এন্ডিং। অগর ঠিক না হো তো সমঝনা পিকচার আভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত।” অর্থাৎ, সিনেমার মতো জীবনেও শেষ পর্যন্ত সব ঠিক হয়ে যায়। যদি না হয় তা হলে বুঝবে সিনেমা এখনও বাকি আছে বন্ধু। দলের ক্রিকেটারদের মধ্যে এই বোধ তিনি ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন। শ্রেয়স, রাসেল, রিঙ্কুরা জেতার আগে পর্যন্ত লড়েছেন। ‘হ্যাপি এন্ডিং’ না হওয়া পর্যন্ত থামেননি তাঁরা। আর সেই লড়াইয়ে তাঁরা পাশে পেয়েছেন কলকাতার লাখ লাখ দর্শকদের। যাঁরা সারা ক্ষণ দলের জন্য গলা ফাটিয়েছেন। দলের সাফল্য কামনা করেছেন।
গত কয়েক বছরে বার বার হারতে হারতে থাকা কেকেআরকে বিদ্রুপ করে অনেকে ‘কেকেহার’ বলতেন। শাহরুখ জানতেন, বার বার হারার অর্থ জীবনের শেষ নয়। এক দিন তিনি জিতবেন। সেটাই এ বার করে দেখিয়েছেন তিনি। কলকাতার হারকে জয়ে বদলে দিয়েছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন, ‘হার কর জিতনে বালোঁ কো বাজিগর কহতে হ্যায়।’ অর্থাৎ, হারার পরে যে জেতে তাকেই বাজ়িগর বলে। এ বারের আইপিএলে তিনিই বাজিগর। ‘পাঠান’, ‘জওয়ান’-এর মতো ছবির হাত ধরে প্রত্যাবর্তন করা বলিউডের ‘বাদশা’ বুঝিয়ে দিয়েছেন, এ ভাবেও ফিরে আসা যায়।