• সন্ত্রাসের ইতিহাসই ‘কাঁটা’ শাসকের কাছে
    আনন্দবাজার | ২৮ মে ২০২৪
  • এক সময়ে বামেদের খাসতালুক ছিল অশোকনগর বিধানসভা কেন্দ্র। ১৯৬৭ থেকে ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে পর্যন্ত এখানে মাত্র দু'বার ছাড়া প্রতি বারই বামেরা বিধানসভা ভোটে জয়ী হয়েছিল। ১৯৭২ সালে কেশবচন্দ্র ভট্টাচার্য এবং ১৯৯৯ সালের উপ নির্বাচনে বাদল ভট্টাচার্য জয়ী হয়েছিলেন অ-বাম প্রার্থী হিসেবে।

    ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে পরিবর্তনের হাওয়ায় ভেঙে পড়ে লাল দুর্গ। সে বার বিধানসভা ভোটে জয়ী হয়েছিলেন তৃণমূলের ধীমান রায়। তারপর থেকে একের পর ভোটে তৃণমূলের জয়জয়কার। হাবড়া ২ ব্লকটি অশোকনগর বিধানসভার মধ্যে পড়ে। পঞ্চায়েত ভোটের দিন এখানে একাধিক বুথে গোলমাল, অশান্তি ছড়িয়েছিল। বোমাবাজি, সংঘর্ষ, ব্যালট লুট, ছাপ্পা, রিগিংয়ের অভিযোগ ওঠে। ব্যালট বাক্স জলে ফেলে দেওয়া হয়। ভোটের দিন বিড়া রাজীবপুর পঞ্চায়েত এলাকায় একটি বুথের কাছে আক্রান্ত হয়েছিলেন অশোকনগর-কল্যাণগড়ের পুরপ্রধান তৃণমূলের প্রবোধ সরকার। এক তৃণমূল প্রার্থী ব্যালট চিবিয়ে খেয়ে নেন। তৃণমূলের এক এজেন্ট ব্যালট সহ পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। সিপিএম-আইএসএফ প্রতিবাদ করলে পুলিশ লাঠি চালায়, কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটায় বলে অভিযোগ। নির্বাচন কমিশন তিনটি বুথের চারটি আসনে ভোট বাতিল করে। পঞ্চায়েত ভোটে গোলমালের জন্য অশোকনগরের প্রাক্তন বিধায়ক তথা বতর্মান উপ পুরপ্রধান ধীমান রায় সাংবাদিক বৈঠক করে স্থানীয় মানুষের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে নানা ঘটনায় ধীমানের সঙ্গে বিধায়ক নারায়ণ গোস্বামী এবং পুরপ্রধান প্রবোধ সরকারদের বিরোধী প্রকাশ্যে চলে এসেছে। এরই মধ্যে গুমা ১ পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান বিজন দাস খুন হওয়ায় ওই এলাকায় নেতৃত্বের অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলে দলের অন্দরের খবর। তা ছাড়া, তৃণমূল নেতা-কর্মীদের একাংশের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপোষণেরও অভিযোগ আছে।

    তবে তৃণমূলের পক্ষে যেতে পারে গত পঞ্চায়েত এবং পুরসভার ফলাফল। পুরসভার ২৩ ওয়ার্ডের মধ্যে ২০টি তৃণমূলের দখলে। ২টি সিপিএম, একটি কংগ্রেসের দখলে। সব ক’টি গ্রাম পঞ্চায়েত এবং পঞ্চায়েত সমিতি তৃণমূলের দখলে। পুরসভা প্রচুর উন্নয়নমূলক কাজ করেছে বলে দাবি শাসক শিবিরের। পুরপ্রধান প্রবোধ সরকার বলেন, "পঞ্চায়েত ভোটে সন্ত্রাসের অভিযোগের কোনও প্রভাব পড়বে না লোকসভা ভোটে। কারণ, অভিযোগ ছিল ভিত্তিহীন। এ বার আমরা বিধানসভার জয়ের লিড ধরে রাখতে পারব।’’ অশোকনগরে বহু বছর ধরেই বিজেপির কিছু শক্তি ছিল। ১৯৯৯ সালে বিধানসভার উপনির্বাচনে অশোকনগর থেকে জয়ী হয়েছিলেন বিজেপি প্রার্থী বাদল ভট্টাচার্য। তখন অবশ্য তিনি তৃণমূলের সঙ্গে জোট প্রার্থী ছিলেন। বাদলই রাজ্যের বিজেপির প্রথম বিধায়ক ছিলেন। গত লোকসভা ভোটে বিজেপি ভাল ফল করে এই এলাকায়। সাংগঠনিক ভাবে তাদের শক্তিবৃদ্ধি হয়েছে বলে দাবি নেতৃত্বের। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে বিজেপি পেয়েছিল ৮.৩৭ শতাংশ ভোট। গত লোকসভায় তা এক লাফে বেড়েছে ৩৯.৬৪ শতাংশ। গত বিধানসভা ভোটে বিজেপি প্রার্থী তনুজা চক্রবর্তী পরাজিত হলেও পান ৩২.৩২ শতাংশ ভোট।

    তবে বিজেপির কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে, দলের আদি ও নব্য গোষ্ঠীর বিবাদ। বনগাঁ দক্ষিণ কেন্দ্রের বিজেপি বিধায়ক স্বপন মজুমদারকে এ বার দল বারাসত কেন্দ্রে প্রার্থী করেছে। কর্মীদের একাংশ চেয়েছিলেন, স্থানীয় কাউকে প্রার্থী করা হোক। যদিও অশোকনগরে ভাল করার বিষয়ে আশাবাদী স্বপন। তিনি বলেন, ‘‘অশোকনগরের মানুষ এ বার পঞ্চায়েত ভোটে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ভোট দেবেন। আমাদের মধ্যে কোনও ভুল বোঝাবুঝি নেই। সকলেই একত্রে তৃণমূলকে হারাতে লড়াই করছেন।"

    ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে এখানে বামেরা পায় ৩৮.২৮ শতাংশ ভোট। লোকসভায় তা কমে দাঁড়ায় ৯.৬৫ শতাংশে। গত লোকসভা ভোটে অশোকনগরে এলাকায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে বিজেপি। তবে আমপান ও করোনা পরিস্থিতিতে বামেরা জনসংযোগ বাড়িয়ে নিয়েছে বলে দলের দাবি। দীর্ঘ দিন ধরে গরিব মানুষকে রান্না করা খাবার দেওয়া হয়েছে। বিনামূল্যে আউটডোর চিকিৎসা পরিষেবা চালু করা হয়েছে। জলমগ্ন এলাকায় ওষুধ, খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছেন বাম কর্মী-সমর্থকেরা। ইদানীং সিপিএমের মিটিং-মিছিলে ভিড়ও চোখে পড়ছে। তরুণ প্রজন্মকে আসতে দেখা যাচ্ছে।

    অতীতে সিপিএম নেতৃত্ব গোষ্ঠীকোন্দলে বিভক্ত ছিলেন। এখন অবশ্য নেতৃত্বের মধ্যে ঐক্যই দেখা যায়। কংগ্রেসের সঙ্গে বামেদের যৌথ কর্মসূচিতেও সাড়া মিলছে। অশোকনগরের প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক সত্যসেবী কর বলেন, "২০১১ সালের বিধানসভা ভোটের পরে এ বারই অশোকনগরে আমাদের সব থেকে ভাল ফল হতে চলেছে।"

    অশোকনগরের বাসিন্দা তথা আইএসএফের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সভাপতি তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় এ বার বারাসত কেন্দ্রের প্রার্থী। গত বিধানসভা ভোটে অশোকনগরে তিনি বাম-আইএসএফ জোটের প্রার্থী ছিলেন। এ বার কী রকম ফল হবে? তাপস বলেন, "এই প্রথম অশোকনগরের কোনও ভূমিপুত্র লোকসভা ভোটে লড়াই করছে। এখানকার মানুষ আমাকে ঢেলে ভোট দেবেন বলেই আমার বিশ্বাস। মানুষ বিজেপি ও তৃণমূলের বিকল্প চাইছিলেন, তা পেয়ে গিয়েছেন।"

    রাজনৈতিক মহলের অনেকেই মনে করছেন, অশোকনগর কেন্দ্রে মতুয়া উদ্বাস্তু ও তফসিলি সমাজেরবহু মানুষের বাস। নাগরিকত্বের বিষয়টিও এখানকার ভোটে বড় ফ্যাক্টর হতে চলেছে।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)