• ক্রমে বন্ধ ঝাঁপ, নাম নেই নতুন উদ্যোগের
    আনন্দবাজার | ২৮ মে ২০২৪
  • চলতি লোকসভা ভোটের প্রচার-পর্বে দুর্গাপুর-সহ পশ্চিম বর্ধমান শিল্পাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি আলোচ্য বিষয় হয়েছে শিল্প-পরিস্থিতি। গত কয়েকটি ভোটের মতোই এ বারও প্রচারে নেমে নানা পক্ষ এলাকায় বিবর্ণ হতে বসা শিল্পের জন্য অপর পক্ষকে দায়ী করেছে। ক্ষমতায় এলে তারা ভোল পাল্টে দেবে, এমন আশ্বাসও শোনা গিয়েছে। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সবাই সভা করে শিল্প নিয়ে আশ্বাস-বাণী শুনিয়ে গিয়েছেন। তবে শহরবাসীর বড় অংশই শিল্পশহরের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য রাজ্য ও কেন্দ্র, দু’পক্ষকেই দায়ী করছেন।

    মূলত ষাটের দশক থেকে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের নানা বড় কারখানা মাথা তুলতে শুরু করে দুর্গাপুরে। বড় বড় সংস্থাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে আরও ছোট-বড় কল-কারখানা। রূপ পায় শিল্পশহর। কিন্তু নব্বইয়ের দশক থেকে ছবিটা পাল্টাতে শুরু করে। শহরের তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা ভারত অপথ্যালমিক গ্লাস লিমিটেড (বিওজিএল), মাইনিং অ্যান্ড অ্যালায়েড মেশিনারি কর্পোরেশন (এমএএমসি) এবং হিন্দুস্থান ফার্টিলাইজার কর্পোরেশন লিমিটেড (এইচএফসিএল) বন্ধ হয়ে যায় একে-একে। এক সময়ে তিন কারখানায় মোট স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা ছিল প্রায় দশ হাজার। কারখানা বন্ধের প্রভাব পড়া শুরু হয় এলাকার অর্থনীতিতে।

    ১৯৭২ সালে চালু হওয়া বিওজিএলে চশমার লেন্স থেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক বা ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারের প্রয়োজনীয় কাচ তৈরি হত। লোকসানে চলা কারখানা ২০০৭ সালে বন্ধ হয়ে যায়। সময়ের সঙ্গে কিছু যন্ত্রাংশ চুরি যায়। বাকিটা নিলামে কেনে একটি বেসরকারি সংস্থা। ১৯৬৫ সালে চালু হয় মূলত খনির কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি উৎপাদনের কারখানা এমএএমসি। রুগ্‌ণ হওয়ায় ১৯৯২ সালে ‘বোর্ড ফর ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল রিকনস্ট্রাকশন’ (বিআইএফআর)-এর অধীনে যায় কারখানা। ২০০২ সালের গোড়ায় ঝাঁপ পড়ে। ২০০৭ সালে তিন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিইএমএল, সিআইএল এবং ডিভিসি কনসোর্টিয়াম গড়ে এবং ২০১০ সালে হাই কোর্টে নিলামে ১০০ কোটি টাকা দর দিয়ে কারখানাটি নেয়। কিন্তু এখনও কারখানা খোলার কোনও ইঙ্গিত নেই। এইচএফসিএল কারখানায় ইউরিয়া উৎপাদন শুরু হয় ১৯৭৪ সালে। ১৯৯৮ সালে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৩ সালে কর্মীদের স্বেচ্ছাবসর দিয়ে কারখানাকে পাঠানো হয় বিআইএফআর-এ।

    বিওজিএল আর খুলবে না, প্রায় নিশ্চিত সবাই। তবে এমএএমসি বা এইচএফসিএল খোলার সম্ভাবনা একেবারে শেষ হয়ে যায়নি বলে মনে করে শিল্পমহল। এমএএমসি চালুর বিষয়ে কনসোর্টিয়াম মাঝে মাঝে বৈঠক বা পরিদর্শন করে। শেষ পরিদর্শন হয়েছিল ২০২০ সালে। ২০২১-এ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, এই কারখানায় উৎপাদন চালুর সম্ভাবনা ও বাস্তবতার দিকটি দেখার দায়িত্ব দেওয়া হবে একটি সংস্থাকে। পরবর্তী অগ্রগতি এখনও প্রকাশ্যে আসেনি। ২০১১ সালে অর্থনীতি বিষয়ক ক্যাবিনেট কমিটি এইচএফসিএল কারখানার পুনরুজ্জীবনের প্রশ্নে সায় দেয়। কেন্দ্রে বিজেপির সরকার আসার পরে তৎকালীন সার প্রতিমন্ত্রী নিহাল চাঁদ আশ্বাস দেন, নিলাম করে বেসরকারি উদ্যোগে কারখানাটি চালু করা হবে। এ বার ভোট মরসুমে দুর্গাপুরে এসে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অর্জুন রাম মেঘওয়াল এই কারখানা সম্পর্কে খোঁজখবর করায় খানিক আশা তৈরি হয়েছে শহরে।

    রাজ্য সরকারি সংস্থা দুর্গাপুর কেমিক্যালস লিমিটেড (ডিসিএল) গড়ে উঠেছিল ১৯৬৩ সালে। ফেনল, কস্টিক সোডা, ক্লোরিন, বেঞ্জিন-সহ নানা রাসায়নিক ও উপজাত সামগ্রী উৎপাদন হত। লোকসানে চলা এই কারখানায় দূষণ ছড়ানোর দায়ে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে উৎপাদন বন্ধ। রাজ্য সরকারের দাবি, কারখানা বন্ধ করা হয়নি। লোকসানের হাত থেকে বাঁচাতে ২০১৬ সালে কারখানার বিলগ্নিকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

    আর এক রাজ্য সরকারি সংস্থা দুর্গাপুর প্রজেক্টস লিমিটেডকে (ডিপিএল) তিন ভাগে ভাগ করে ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে অন্য তিন বিদ্যুৎ সংস্থার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। উদ্বৃত্ত কর্মীদের অন্য দফতরে বদলি করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী এ বার ভোটের প্রচারে দুর্গাপুরে এসে জানিয়ে গিয়েছেন, ৮০০ কোটি টাকা খরচ করে ডিপিএলকে ঢেলে সাজা হচ্ছে।

    নব্বইয়ের দশকের শেষ দিক থেকে রাতুড়িয়া-অঙ্গদপুর, খয়রাশোল, বাঁশকোপা, বামুনাড়া, কমলপুরের মতো কয়েকটি এলাকায় গড়ে ওঠে প্রায় ৫০টি বেসরকারি ইস্পাত, ধাতব ও অনুসারী কারখানা। সেগুলির প্রায় অর্ধেক এখন বন্ধ। বাকিগুলিতে উৎপাদন কমেছে। কাজ হারিয়েছেন কয়েক হাজার ঠিকা শ্রমিক। এক সময়ে রমরমা ছিল ক্ষুদ্র ইঞ্জিনিয়ারিং, ফেব্রিকেশন, রিফ্যাকট্রি শিল্পের। ভারী শিল্প সংস্থায় প্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরি হয় এ সব কারখানায়। সগড়ভাঙার আরআইপি শিল্পতালুক, জাকির হোসেন অ্যাভিনিউয়ের মতো এলাকায় প্রায় চারশো কারখানা ছিল। দুর্গাপুর স্মল ইন্ডাস্ট্রিজ় অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, এখন খাতায়কলমে শ’খানেক রয়েছে। তার মধ্যে আদতে চালু রয়েছে ৩০-৪০টি।

    এত হতাশার মধ্যে খানিক আশা জাগানোর পরিস্থিতি দু’টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায়। ডিএসপি এবং ডিটিপিএস— দু’টিতেই সম্প্রসারণ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন তৈরি হয়েছে সেখানেও।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)