কমলা জামা পরা কয়েক জন লোক বাঁধ বরাবর হাঁটতে হাঁটতে হাতে মাইক নিয়ে বলে বলে যাচ্ছিল, ‘ঝড় আসছে, সতর্ক থাকুন। প্রশাসনের নির্দেশ মেনে চলুন। নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিন।’ রবিবার সকালে তখনও আমাদের কিছু খাওয়া হয়নি। ঘরে শয্যাশায়ী স্বামী। কোথায় যাবতাঁকে নিয়ে?
সাগরের চকফুলডুবি মন্দিরতলায় হুগলি নদীর বাঁধের ধারে আমাদের ছোট্ট খড়ের চালের ঘর। দু’জনে দিনমজুরি করেও যেটুকু আয় হয়, তাতে নুন আনতে পান্তা ফুরনোর দশা। খড়ের বদলে টিনের চাল দেওয়ার ক্ষমতাটুকুও নেই। অল্প বৃষ্টিতেই খড়ের চাল ফুটো হয়ে জল পড়ে ঘরের মধ্যে। ঘূর্ণিঝড় আসছে, তা জানতাম। ঘর পোড়া গরু আমরা। সিঁদুরে মেঘ দেখলেই মন ডরায়। আয়লা, আমপান, ইয়াস আরও কত বার ভরা কটালে বানভাসি হয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। জমি, পুকুর সব কিছু গ্রাস করেছে এই হুগলি নদী। শুধু তিন পুরুষের ভিটের টানে এর পাশ থেকে সরতে পারিনি।
জৈষ্ঠ্যের দুপুরে বাঁধের ধারে এই চালা ঘরের দাওয়ায় বসলে প্রাণ জুড়ানো বাতাস বয়। সেই বাতাসই প্রাণ কাড়বে!
এতগুলো ঝড়-ঝঞ্ঝা পার করেও শেষ সম্বল নদীর ধারের কুঁড়েঘর ছেড়ে কোথাও যাওয়ার কথা ভাবতে পারি না। প্রতিবেশীরা সবাই ফ্লাড শেল্টারে চলে গেল দুপুর গড়ানোর আগেই। ঘরে চাল বাড়ন্ত। দোকান বন্ধ। আধপেটা খেয়ে দিনটা কোনও রকমে কাটল। অসুস্থ মানুষটাকে নিয়ে কী করব বুঝতে পারছিলাম না।
হাওয়ার দাপট তো ছিলই, বিকেল থেকে শুরু হল বৃষ্টি। সন্ধ্যা নামতেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঝড় শুরু হয়েছে। ঘরের মধ্যে ক’টা বাসন, বালতি ছিল মেঝেতে বসানো। ঝর ঝর করে জল পড়ছে খড়ের চালের ফাঁক দিয়ে। রান্নার জায়গায় মাটির উনুনে জল ভর্তি। হাওয়ার ধাক্কায় দরজার ছিটকিনি খুলে যাওয়ার জোগাড়। বিছানায় আমরা দু’জন শক্ত করে দু’জনকে ধরে আছি। কে জানে, এ ভাবেই হয়তো শেষ মুহূর্তটা আসবে!
খাবার নেই, জল নেই। অসহায় দু’টো মানুষের আতঙ্কের রাত কেটে গেল কী ভাবে জানি না। প্রশাসনের কাছে বিনীত অনুরোধ, বার বার ঝড় আসার আগে সতর্ক করার পাশাপাশি পাকা বাঁধ করে দিন, নদীকে এত ভয় পেতে হয় না তবে।