লোকসভা ভোটের ফল কী হবে, এখনও অজানা। তবে এ বারের প্রচারের অভিজ্ঞতা থেকে উৎসাহ পেয়ে রাজ্যে আগামী বিধানসভা নির্বাচনেও জোট বেঁধে লড়াইয়ের লক্ষ্যে মানসিক প্রস্তুতি রাখছেন সিপিএম ও কংগ্রেস নেতৃত্ব। দু’দলেরই শীর্ষ নেতৃত্বের মত, লোকসভা ভোটে এ বারের প্রচারে তাঁরা যে দেখেছেন, এ রাজ্যে ২০১৬ বা ২০২১ সালে তেমন দেখেননি!
বিধানসভা নির্বাচনের জন্য ২০১৬ সালেই প্রথম বার কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা করেছিল বামফ্রন্ট। সে বারের ভোটে বহু আসনে তৃণমূল কংগ্রেসের জয়ের ব্যবধান তারা যেমন কমিয়ে আনতে পেরেছিল, তেমনই ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মাথা তোলা বিজেপিকে আবার পিছনে ঠেলে দেওয়া গিয়েছিল। সংখ্যায় বেশি বিধায়ক পাওয়ায় ভোটের পরে বিরোধী দলনেতা হয়েছিলেন কংগ্রেসের আব্দুল মান্নান। তবে সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সে সময়ে ওই আসন সমঝোতায় সম্মতি ছিল না। আবার কংগ্রেসের সব ভোট বামেদের দিকে এসেছে কি না, সেই প্রশ্নেও বিতর্ক হয়েছিল বিস্তর। এর পরে ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটেও দু’পক্ষ হাত মিলিয়ে লড়াই করেছে। কিন্তু দু’দলের ঝুলিই তখন থেকে শূন্য!
শূন্যের উপরে দাঁড়িয়ে এ বারই প্রথম লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় আসন সমঝোতা করেছে কংগ্রেস ও বামেরা। দলের সর্বভারতীয় সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গের একটি সভা বাদ দিয়ে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সে ভাবে বাংলায় প্রচারে গা লাগাননি। সিপিএমের শীর্ষ নেতারা অবশ্য রাজ্যের নানা আসনে ঘুরে কখনও একক, কখনও কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথ ভাবে প্রচার করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই এ বার বেশ কিছু ‘পরিবর্তন’ দেখতে পাচ্ছেন সীতারাম ইয়েচুরি। আনন্দবাজারের সঙ্গে একান্ত কথোপকথনে সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক বলছেন, ‘‘আগে যে দু’বার জোট হয়েছিল, তখনও বাংলায় প্রচারে এসেছিলাম। তবে এ বার গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরিবর্তন চোখে পড়েছে। যেমন, সিপিএম তথা বামেদের কথা শোনার জন্য অনেক বেশি মানুষ ভিড় করছেন। বিশেষত, তরুণ প্রজন্মের উৎসাহ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সিপিএম ও কংগ্রেসের রসায়নও আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়েছে।’’ প্রচারে কেন এমন সাড়া মিলছে, তার ব্যাখ্যাও দিচ্ছেন ইয়েচুরি। তাঁর কথায়, ‘‘রাজ্যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা তীব্র হয়েছে। দুর্নীতি, অপশাসনের একের পর এক নমুনা সামনে এসেছে। আবার কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদীর সরকার যা করেছে, তাতে সর্বত্রই বিজেপির প্রতি অসন্তোষ আছে। বাংলাতেও বিজেপির প্রতি মোহ কাটছে। এই পরিস্থিতিতে মানুষ এগিয়ে এসে বামপন্থীদের কথা, কংগ্রেসের কথা শুনছেন।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘আমাদের অবস্থান একই আছে। মানুষ নিজেদের অভিজ্ঞতায় এখন আরও উৎসাহ দেখাচ্ছেন আমাদের বক্তব্য শুনতে।’’
বহরমপুরে নিজের আসনে প্রবল লড়াই দেওয়ার পাশাপাশি রাজ্যের অন্যত্রও প্রচারে ঘুরেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি এবং এআইসিসি-র ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য অধীর চৌধুরী। প্রচারের মধ্যেই তিনি বলে দিয়েছেন, ২০২৬ সালেও বাম ও কংগ্রেস জোট রাজ্যে বিজেপি এবং তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উপমা টেনে অধীর বলছেন, ‘‘প্রথমে নিম্নচাপ, সেখান থেকে যেমন ঘূর্ণিঝড় ঘনীভূত হয়, সে ভাবেই বাম ও কংগ্রেসের রসায়নকে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে। আগেও জোট হয়েছিল, তাতে কিছু ভুলও হয়েছিল। কিছুটা উপর থেকে নিয়ে আসার ব্যাপার ছিল। কিন্তু এ বারেরটা অনেক স্বতঃস্ফূর্ত। দু’দলের নেতা-কর্মীরাই আন্তরিক ভাবে জোটে শামিল হয়েছেন, মনস্তাত্ত্বিক ভাবে তাতে সুবিধা হয়েছে।’’ সিপিএমের সাধারণ সম্পাদকের মতো প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতিরও অভিজ্ঞতা, ‘‘বিজেপি ও তৃণমূল নিজেদের বিপদ বুঝে শুধু মেরুকরণের চেষ্টা করছে। প্রধানমন্ত্রী একের পর এক মিথ্যা বলছেন, মেরুকরণ করতে তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী! আমরা যে মানুষের জীবনের আসল সমস্যার কথা, সম্প্রীতির কথা বলছি, সেটা তাঁরা শুনতে আসছেন। প্রচারে আমরা আগের চেয়ে বেশি সাড়া পেয়েছি।’’
এই লোকসভার ফল যা-ই হোক, ২০২৬-এ নজর রেখে সিপিএম ও কংগ্রেস তা হলে জোট বেঁধে লড়তে তৈরি? অধীর বলছেন, মনস্তাত্ত্বিক ভাবে তাঁরা তৈরি। আর ইয়েচুরির বক্তব্য, ‘‘নিচু তলায় বাম ও কংগ্রেস কর্মীরা এই সমঝোতা রেখেই বিধানসভা নির্বাচনে লড়তে চান। তবে কংগ্রেসের হাই কমান্ড আছে। বাকিটা তাদের উপরেই নির্ভরশীল!’’ তবে এই লোকসভা ভোট থেকে রসদ নিয়েই যে দু’বছর পরে বিধানসভার ময়দানে নামা হবে, সেই প্রশ্নে এক বিন্দুতে দু’পক্ষই।