এ জে সি বসু রোড ধরে পরপর গাড়ি দাঁড় করানো। এক ঝলক দেখলে মনে হবে, ‘পার্কিং জ়োন’! কিন্তু এত গাড়ি এখানে কেন? ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে টানা বৃষ্টির দুপুরে জানা গেল, গাড়িগুলির কোনওটি ঠনঠনিয়া এলাকার, কোনওটি আবার আমহার্স্ট স্ট্রিটের কোনও বাসিন্দার। ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাস শুনে সব ক’টি গাড়িকেই অপেক্ষাকৃত উঁচু রাস্তা এ জে সি বসু রোডে এনে রেখে দেওয়া হয়েছে। খোঁজ নিয়ে এ-ও জানা গেল, এই এলাকায় এটাই দস্তুর। জলে ডুবে যাওয়া থেকে গাড়ি বাঁচাতে উত্তর কলকাতার এই উঁচু রাস্তাতেই সেগুলি নিয়ে এসে রেখে যান বাসিন্দারা!
তবে, গত দু’দিনে বহু ক্ষেত্রেই এ ভাবে গাড়ি সরিয়ে রেখেও রক্ষা মেলেনি। কলকাতা পুলিশ সূত্রেই খবর, গত তিন দিনে ২৪ ঘণ্টা কাজ করেছে তাদের গাড়ি সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্রেনগুলি। শুধুমাত্র কলকাতা পুলিশকেই ৬০০-র বেশি এমন গাড়ি সরাতে হয়েছে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে। যার মধ্যে জলে ডুবে আটকে যাওয়া গাড়ির সংখ্যা প্রায় ২৫০। এ নিয়ে রীতিমতো উদ্বিগ্ন কলকাতা পুলিশের ট্র্যাফিক বিভাগের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘এ ভাবে চললে আরও ক্রেন কিনতে হবে।’’ ওই অফিসারের দাবি, যে ভাবে কলকাতায় ঝড়ের প্রভাব পড়ার মতো ঘটনা বেড়েছে, তাতে এ নিয়ে গাড়ির মালিকদেরও আলাদা করে ভাবা দরকার। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই উঠে আসছে, এমন ক্ষেত্রে গাড়ি নিরাপদে রাখার জন্য বিশেষ বিমা করানোর ব্যাপারে মালিকদের সচেতনতা না থাকার প্রসঙ্গ।
জানা গিয়েছে, সচেতনতার অভাবেই জলে ডুবে যাওয়া গাড়ি নিয়ে হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছে গাড়ির সার্ভিস সেন্টারগুলিতে। ই এম বাইপাসের এমনই একটি সার্ভিস সেন্টারের কর্মী বাপ্পা ঘোষ বললেন, ‘‘জলে ভিজলে ‘এ’, ‘বি’ এবং ‘সি’— তিন পর্যায়ে গাড়ির ক্ষতি হতে পারে। গাড়ির বাম্পার ছুঁইছুঁই জলে ক্ষতি হয় ‘এ’ পর্যায়ের। তাতে গাড়ি সারানোর খরচ কম। গাড়ির ইঞ্জিন ডুবে গেলে ‘বি’ পর্যায়ের ক্ষতি হয়। তাতে সারানোর খরচ ‘এ’ পর্যায়ের থেকে বেশি। সম্পূর্ণ ভাবে গাড়ি ডুবে গেলে সে ক্ষেত্রে ‘সি’ পর্যায়ের ক্ষতি হয়।’’ বিমা থাকলে ঠিক আছে। নয়তো কোনও গাড়ির ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হলে ৬০-৭০ হাজার টাকা অথবা লক্ষাধিক টাকাও খরচ হতে পারে বলে জানা যাচ্ছে।
গাড়ি সারাইয়ের একটি সংস্থার এক কর্মীর দাবি, বর্তমানে ‘বিএস-৬’ স্তরের যে সমস্ত গাড়ি বিক্রি হচ্ছে, সেগুলিতে বেশি মাত্রায় ‘সেন্সর’ ব্যবহার হয়। এমন গাড়িই জলের প্রভাবে সমস্যায় পড়ছে বেশি। জলে ভেজা ইঞ্জিনের অংশ পড়ে থাকতে থাকতে তাতে মরচেও ধরে যেতে পারে। একটি আন্তর্জাতিক গাড়ি সংস্থার পূর্বাঞ্চলীয় শাখার ম্যানেজার পবন সিংহ বললেন, ‘‘কলকাতাকে এমনিতে জল জমার জন্য বিপজ্জনক হিসাবে ধরা হয় না। তাই ডুবে গিয়ে বা অন্য কোনও ভাবে ইঞ্জিনের ক্ষতি হতে পারে বলে মনে করা হয় না। ফলে বিমা করানোর সময়ে এ দিকে অনেক সময়েই বিশেষ নজর দেওয়া হয় না।’’
ফি-বছর কলকাতার বেশ কিছু আন্ডারপাসের নীচে বাস বা অন্য গাড়ি আটকে থাকার ঘটনা ঘটে। ‘জয়েন্ট কাউন্সিল অব বাস সিন্ডিকেটস’-এর সাধারণ সম্পাদক তপন বন্দ্যোপাধ্যায় এ নিয়ে বললেন, ‘‘এ বার ভোটের কাজে বেশির ভাগ বাস বাইরে থাকায় সমস্যা সে ভাবে হয়নি।’’ যদিও বাসমালিকদের দাবি, ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে টালবাহানা, আয়ের চেয়ে খরচ বেশি হয়ে যাওয়ায় বহু বাসেই পর্যাপ্ত বিমা করিয়ে রাখা যাচ্ছে না।
তা হলে উপায়? স্পষ্ট উত্তর মেলে না। অতীতে একই ভাবে বিপদে পড়া কেবি-১৬ রুটের একটি বাসের কন্ডাক্টর নিমাই ঘোষ বললেন, ‘‘জমা জলে যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে বাসের দরজায় তালা ঝুলিয়ে সরে পড়া ছাড়া উপায় থাকে না।’’