ভোট এলে এখনও আতঙ্কে কাঁপে নিহত আইএসএফ কর্মীর পরিবার
আনন্দবাজার | ২৯ মে ২০২৪
বাড়ির বাইরে সামান্য চিৎকার-চেঁচামেচি হলে এখন ভয় পেয়ে যায় সাত বছরের মরিয়ম। তিন বছর আগে এক দিন ভোটের ফলাফল বেরিয়েছিল। পরের দিন সকালে স্বামী মহম্মদ হাসানুজ্জামানের সঙ্গে নিজেদের পাট খেতে কাজ করতে যাচ্ছিলেন মরিয়মের মা মারুফা বিবি। কিন্তু গ্রামের পরিবেশ সে দিন ছিল অন্য রকম। পাট খেতে যাওয়ার পরেই এক দল লোক মারতে মারতে মারুফাকে স্বামীর থেকে আলাদা করে দেয়। আর এক দল লোক তাড়া করে হাসানুজ্জামানকে। খানিক বাদেই বোমার শব্দ। তার পরেই মারুফা খবর পান, আইএসএফ কর্মী হাসানুজ্জামানের দেহ পড়ে রয়েছে পাট খেতে।
লোকসভা ভোটের আবহে এক দুপুরে সেই মর্মান্তিক ঘটনার কথাই শোনাচ্ছিলেন দেগঙ্গার কদম্বগাছি পঞ্চায়েতের উলা গ্রামের বাসিন্দা মারুফা। স্বামী হাসানুজ্জামান পেশায় ভাঙাই মিস্ত্রি হলেও আইএসএফের সক্রিয় কর্মীও ছিলেন। মারুফা জানান, এলাকার মসজিদের জমিতে একটি ক্লাব তৈরি করা হয়েছিল। সেটি ভাঙা পড়ে। মারুফা বলেন, ‘‘মিস্ত্রি হওয়ায় অন্যদের সঙ্গে ক্লাবটি ভাঙার কাজে যুক্ত ছিলেন আমার স্বামীও। তৃণমূলের লোকজন ওই ক্লাব তৈরি করেছিলেন। কিন্তু আমার স্বামী আইএসএফ করায় ওঁকে নিশানা করা হল। বিধানসভা ভোটের ফল বেরোনোর পরের দিন সকালেই আমার স্বামীকে খুন করা হয়। সিবিআই তদন্ত করে কয়েক জনকে গ্রেফতার করলেও এখনও অনেকেই অধরা। এখন ভোট আসা মানেই ভয়ে বুক কাঁপতে থাকে। আমরা তো আইএসএফের সমর্থক।’’ ২০২১ সালে বিধানসভা ভোটের ফল বেরোনোর পরে সেটাই ছিল প্রথম রাজনৈতিক খুন।
তিন মেয়েকে নিয়ে সংসার মারুফার। স্বামীর মৃত্যুর পরে সংসারে অভাব জাঁকিয়ে বসেছে। রেশনের চাল আর সেলাই থেকে রোজগারই ভরসা। প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িতে দেন প্রতিবেশীরা। উলা গ্রামে হাসানুজ্জামানের বাড়িতে গিয়ে কথা হল পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গেও। তাঁর দাদা জহরুল ইসলাম বললেন, ‘‘ভাই খুন হওয়ার পরে মনে হয়েছিল, ওরা সে দিন তৈরি হয়েই এসেছিল। আমার খেত আর ভাইয়ের খেত রাস্তার দু’দিকে। সে দিন সকালে আমিও খেতের দিকেই যাচ্ছিলাম। দু’-তিন জন এসে প্রথমে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে দিল। তার পরে কোথা থেকে ৩৫-৪০ জন এসে চড়াও হল। ভাইকে ধাওয়া করে অন্য দিকে নিয়ে গেল। তার খানিক ক্ষণ বাদে যাওয়ার সময়ে ওরা ভাইয়ের নাম করে বলে গেল, আইএসএফ কর্মী খুন হয়েছে।’’ হাসানুজ্জামানকে তলোয়ার দিয়ে কুপিয়ে খুন করা হয়েছিল বলেই অভিযোগ পরিবারের।
আগামী শনিবার, ১ জুন নির্বাচন বারাসত লোকসভা কেন্দ্রে। ওই কেন্দ্রের অধীনেই দেগঙ্গার কদম্বগাছি পঞ্চায়েত। সেখানেই উলা গ্রাম। ওই গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ তৃণমূল সমর্থক, এক-তৃতীয়াংশ আইএসএফ সমর্থক। গোটা পঞ্চায়েতে মাত্র চার জন আইএসএফের সদস্য। যদিও ওই দলের দাবি, দেগঙ্গা বিধানসভা কেন্দ্র এলাকায় তারা যথেষ্ট শক্তিশালী। তবু হাসানুজ্জামানের খুনের পরে ভোটের সময় এলেই সতর্ক থাকে তাঁর পরিবার। মারুফার কথায়, ‘‘আমার স্বামীর খুনের ঘটনায় যারা জড়িত, তাদের অধিকাংশই আমাদের প্রতিবেশী। কিন্তু সে দিন ওরা সব তৃণমূল হয়ে গিয়েছিল। নৃশংস ভাবে আমার স্বামীকে খুন করা হয়। হাতের একটি অংশ কাটা ছিল। সাত বছরের ছোট মেয়েটা এখনও মাঝে মাঝে বাবার কথা জিজ্ঞাসা করে কষ্ট পায়।’’
প্রতিবেশীদের একাংশ এবং হাসানুজ্জামানের পরিবারের অভিযোগ, অভিযুক্তেরা তৃণমূলের এক নেতার ঘনিষ্ঠ ছিল। তা সত্ত্বেও কোনও রকম সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার শাসকদলের তরফে পাওয়া যায়নি। এই তিন বছরে কোনও নেতা তাঁদের দেখতে আসেননি বলে অভিযোগ হাসানুজ্জামানের আর এক দাদা এমদাদুল ইসলামের। যদিও উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের অধ্যক্ষ তথা বারাসত-১ পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সভাপতি মহম্মদ আরশাদউজ্জামান বলেন, ‘‘ছেলেটি মারা গিয়েছিল বোমা ফেটে। ওর সঙ্গেই বোমা ছিল। কেউ ওকে কোপায়নি। আমি ব্যক্তিগত ভাবে ওই পরিবারটিকে সাহায্য করেছিলাম।’’