• যুবনেতা থেকে জনপ্রতিনিধি হয়ে ‘জনগর্জন’-এর মুখ! তৃণমূলের ‘ফার্স্ট বয়’-এর উত্থান সেনাপতির মতোই
    আনন্দবাজার | ৩০ মে ২০২৪
  • ২০১৪ সালে জনপ্রতিনিধি হিসাবে যে যাত্রা শুরু করেছিলেন, তার দ্বিতীয় বৃত্ত পূর্ণ করতে চলেছেন তিনি। ১০ বছরে অনেক কিছু বদলেছে। এত দিন ছিলেন অঘোষিত। এখন তিনি তৃণমূলের ঘোষিত সেনাপতি। এখন আর শুধু জনপ্রতিনিধি নন, বাংলার রাজনীতিতে ‘জনগর্জন’-এর মুখ হয়ে উঠে এসেছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এখন তিনি দলের ‘ফার্স্ট বয়’। আর প্রধান শিক্ষিকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

    ২০১৪ সালে প্রথম সাংসদ হন অভিষেক। যদিও তাঁর রাজনৈতিক যাত্রা শুরু ২০১৪ সালেরও বছর তিনেক আগে ২০১১ সালে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে যেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বছর। ৩৪ বছরের বামশাসন বদলের বছর। সে বছর রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূলের হয়ে ভোটপ্রচারে নামতে দেখা গিয়েছিল অভিষেককে।

    ২০১১ থেকে ২০২৪— রাজনীতিতে এসেছেন, যুবনেতা থেকে নেতা হয়ে দলের অন্যতম মস্তিষ্ক হয়েছেন, ধর্নায় বসেছেন, সমালোচনায় বিদ্ধ হয়েছেন, ঘুরেও দাঁড়িয়েছেন। ৩৬ বছর বয়সি অভিষেকের তুলনা এখন করা হয় রাজ্যের পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদদের সঙ্গে।

    ২০১৯ সালে বাংলার রাজনীতিতে বিজেপির হঠাৎ উত্থান তৃণমূলকে চিন্তায় ফেলেছিল। তবে তার পর থেকেই উঠেপড়ে লাগে তৃণমূল। তার ফলও মেলে রাজ্যের বিধানসভা, পুরসভা এবং পঞ্চায়েত নির্বাচনে। তিনটি নির্বাচনেই ব্যাপক জয় পেয়েছিল তৃণমূল। তৃণমূলের সেই সফল অধ্যায়ের অন্যতম রচয়িতা বলা যায় অভিষেককে। তিনটি নির্বাচনেই মমতার পর তিনিই ছিলেন দলের দ্বিতীয় তারকা প্রচারক। জেলায় জেলায় ঘুরে প্রচার করেছিলেন। অভিষেকের সেই পরিশ্রমের ফল পেয়েছিল তৃণমূল।

    মাত্রই ১৩ বছর আগে রাজনীতিতে আসা এই যুবকের রাজনৈতিক উত্থান চোখে পড়ার মতো। যদিও অভিষেকের সমালোচকদের একাংশ মনে করেন, এই সাফল্য তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। মমতার জনপ্রিয়তা আর তৃণমূলের অন্য নেতাদের পরিশ্রমকে ‘সহজ ভিত্তি’ হিসেবে পেয়েছেন অভিষেক। আবার তাঁর হিতৈষীদের মতে, এই সাফল্য প্রচুর পরিশ্রম করে, ঘাম ঝরিয়ে, মাথা খাটিয়ে অর্জন করেছেন ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ তথা তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক।

    দীর্ঘ দিন ধরে তাঁকে নিয়ে যাবতীয় সমালোচনার জবাব ২০২১ এবং ২০২৩ সালে অভিষেক নিজেই দিয়েছেন। ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন দলকে। সরাসরি মোকাবিলা করেছেন নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ জুটির। পরিণত রাজনীতিকের মতো ব্যবহার করেছেন মঞ্চকে। বক্তৃতাও করেছেন তুখড়।

    এর পর ২০২৩ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে রাজ্যে ‘নবজোয়ার’ যাত্রা শুরু করেন অভিষেক। ৫১ দিনের সেই যাত্রায় প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কিলোমিটারের বেশি পথ চলেছেন তিনি। রাজ্যের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরেছেন। মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। ১৩৫টি জনসভা, ৬০টি বিশেষ অনুষ্ঠান, ১২৫টি রোড শো, ৩৩টি রাতের অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। এর মাঝেই ইডির তলবে কলকাতার সিজিও কমপ্লেক্সে এসে হাজিরাও দিয়ে গিয়েছেন। ফিরে আবার যোগ দিয়েছেন ‘নবজোয়ারে’।

    পঞ্চায়েত নির্বাচনে অভিষেকের সেই যাত্রার প্রাথমিক প্রভাব বোঝা গিয়েছিল। পঞ্চায়েতে ভাল ফল করে তৃণমূল। ‘নবজোয়ারের’ প্রভাব ‘জোয়ার’ এনেছিল তৃণমূলের ভোটে। লোকসভা নির্বাচনেও অভিষেকের ‘নবজোয়ার যাত্রা’র প্রভাব নিয়ে প্রত্যাশী তৃণমূল।

    ১৯৮৭ সালের ৭ নভেম্বর অভিষেকের জন্ম। বাবা অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়, মা লতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতারই এম পি বিড়লা ফাউন্ডেশন হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল থেকে দ্বাদশ উত্তীর্ণ হন তিনি। এর পর মানবসম্পদ এবং বিপণন সংক্রান্ত পড়াশোনা করতে দিল্লি চলে যান। ২০০৯ সালে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ প্ল্যানিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট থেকে এমবিএ করেন অভিষেক। তার পরেও দিল্লিতেই ছিলেন। ২০১১ সালে তিনি কলকাতায় ফেরেন। বাংলার রাজনীতিতে অভিষেকের অভিষেকও সেই বছরেই।

    ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সে ভাবে কোনও সম্পর্ক ছিল না অভিষেকের। ২০১১-এর আগে তৃণমূলের বামবিরোধী আন্দোলনেও ‘সক্রিয়’ হতে দেখা যায়নি তাঁকে। ধর্মতলায় মমতার অনশনে বা সিঙ্গুরের মঞ্চে অবশ্য বার কয়েক দেখা গিয়েছিল তাঁকে। তবে কোনও জনসভায় বক্তৃতা করতে দেখা যায়নি। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে আগে বাংলার রাজনীতিতে প্রথম সক্রিয় হতে দেখা যায় অভিষেককে। তৃণমূলের হয়ে প্রচারে নামেন তিনি। সে বছরই বিধানসভা নির্বাচনে ৩৪ বছরের বামদুর্গের পতন ঘটিয়ে রাজ্যে তৃণমূল এবং কংগ্রেসের যৌথ সরকার গড়েন মমতা।

    বিধানসভা ভোটে জয়ের পর চিরাচরিত প্রথা ভেঙে ২০১১ সালের ২১ জুলাইয়ের ‘শহিদ দিবস’-এর সমাবেশ ব্রিগেডে করেছিল তৃণমূল (সাধারণত ধর্মতলার ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে ‘শহিদ দিবস’ পালন করে তারা)। সেই সভা থেকেই তৃণমূলের ‘কর্পোরেট মুখ’ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল ‘তৃণমূল যুবা’। তৃণমূলের যুব সংগঠন থাকা সত্ত্বেও দলের নতুন সেই যুব শাখা তৈরি হয়েছিল। অভিষেককে সেই সংগঠনের সভাপতি করেছিলেন মমতা।

    অনুগামীদের নিয়ে ‘যুবা’র সভাপতি হিসাবে সাংবাদিক সম্মেলন করেন অভিষেক। সেই সম্মেলনে পৃথক ভাবে সংগঠনের নিয়মানুবর্তিতা প্রকাশ করে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’ নয়, তিনি ‘সাজিয়ে দাও, গুছিয়ে দাও’-এর রাজনীতি করতে এসেছেন।

    এর পরে পরেই ‘যুবা’র সদস্যপদ সংগ্রহে নামেন অভিষেক। এক বছরের মধ্যে চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো সদস্যপদ সংগ্রহ করেন। ৩০ টাকার বিনিময়ে সদস্যপদের পাশাপাশি দেওয়া হত টুপি, টি-শার্ট, মাথায় বাঁধার ‘ব্যান্ডানা’ এবং ব্যানার। সব কিছুতেই লেখা ‘যুবা’। বাজার ছেয়ে যায় সেই সব প্রচারপণ্যে। হোর্ডিংয়ে ব্যানারেও জনপ্রিয়তা পায় ‘যুবা’। শুধু সদস্যপদ আর প্রচারপণ্য থেকেই ২৮ কোটি টাকা তুলেছিল ‘যুবা’।

    তবে ‘যুবা’কে মাঠেঘাটে নেমে সে ভাবে রাজনীতি করতে দেখা যায়নি। মূলধারার রাজনৈতিক স্রোতেও সেই সংগঠন খুব বড় প্রভাব ফেলতে পারেনি বলেই মনে করেন তৃণমূল নেতাদের একাংশ। কিন্তু তৃণমূলের সেই শাখা সংগঠন নিয়েই দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল দলের অন্দরে। তৎকালীন তৃণমূলের যুব সংগঠনের সভাপতি শুভেন্দু অধিকারী ঘনিষ্ঠমহলে প্রশ্ন তুলেছিলেন, একটি দলের দু’টি পৃথক যুব সংগঠন থাকবে কেন?

    তৃণমূল সূত্রের খবর, শুভেন্দুর সেই ক্ষোভের কথা তখনই জেনেছিলেন অভিষেক। জেনেছিলেন দলনেত্রী মমতাও। তবে অভিষেক হাল ছাড়েননি। নিজের মতো করে ‘যুবা’ সংগঠনের কাজ চালিয়ে যান ২০১৪ সাল পর্যন্ত। পাশাপাশি, মমতার ছত্রছায়ায় ধীরে ধীরে রাজনীতির পাঠও পড়তে শুরু করেন। সেই শুরু। তার পর থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি অভিষেককে। দলে শুধু উত্থানই হয়েছে তাঁর।

    এরই মধ্যে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলেজ জীবনের প্রেমিকা রুজিরাকে বিয়ে করেন অভিষেক। দিল্লিতে বসেছিল সেই বিয়ের আসর। ২০১৩ সালে অভিষেক-রুজিরার প্রথম সন্তান কন্যা আজানিয়ার জন্ম। নাম রেখেছিলেন মমতা নিজে।

    তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধের কারণে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে তৃণমূল থেকে কংগ্রেসে ফিরে যান সোমেন মিত্র। সোমেনের ছেড়ে যাওয়া সেই আসনে ভাইপো অভিষেককে প্রার্থী করেন মমতা। মাত্র ২৬ বছর বয়সে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ডায়মণ্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী হন অভিষেক। প্রথম বার দাঁড়িয়ে সিপিআইএমের আব্দুল হাসনত খানকে ৭১ হাজারের বেশি ভোটে হারিয়ে সেই সময়ে লোকসভার কনিষ্ঠতম সাংসদ হয়েছিলেন অভিষেক। ধীরে ধীরে রাজনীতিতে দড় হতে শুরু করেন তিনি। দলের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে প্রথম সারির তৃণমূল নেতাদের পাশাপাশি দেখা যেতে থাকে তাঁকে। দলের অন্দরেও নেতা হিসাবে অভিষেকের গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে শুরু করে।

    ২০১৪ সালেরই জুন মাসে শুভেন্দুকে সরিয়ে রাজ্য তৃণমূলের যুব সভাপতি করা হয়েছিল সৌমিত্র খাঁকে। যা নিয়ে ক্ষোভ জন্মেছিল শুভেন্দুর মধ্যে। একই বছরের ১৭ অক্টোবর অন্য এক সভায় আবার সৌমিত্রকে সরিয়ে তৃণমূলের যুব এবং ‘যুবা’কে মিলিয়ে দিয়ে সেই সংগঠনের জাতীয় এবং রাজ্য স্তরের দায়িত্ব অভিষেকের হাতে তুলে দেন মমতা। ২০১৪ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তৃণমূলের যুব সংগঠনের সভাপতি ছিলেন অভিষেক।

    এরই মধ্যে মমতার ভাইপো হওয়ার কারণে অভিষেকের উত্থান নিয়ে দলের অন্দরে আড়ালে-আবডালে পরিবারতন্ত্রের প্রসঙ্গ টেনে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। তৃণমূলের গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেতার মনেও অভিষেকের ‘প্রভাব’ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়। তৃণমূলের অন্দরের খবর, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুকুল রায়। ২০১৭ সালে মুকুল তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন। পরের বছর, ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের দায়িত্ব দেওয়া হয় অভিষেককে। বিপুল ভোটে পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেতে তৃণমূল।

    ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ডায়মন্ড হারবার থেকে জিতে দ্বিতীয় বারের জন্য সাংসদ হন অভিষেক। দলের অঘোষিত দু’নম্বর হিসেবে অভিষেকের আত্মপ্রকাশও ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পরেই। তার পরের বছর করোনা আঘাত হানে সারা বিশ্বে। দীর্ঘ লকডাউনের পর পরিস্থিতি যখন আবার ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে, তখন রাজনীতির ময়দানে অভিষেককে দেখে অনেকেই চমকে গিয়েছিলেন। নাদুসনুদুস চেহারার উপর গোল মুখ আর ফোলা ফোলা গাল নেই। মেদ ঝরিয়ে অভিষেক ছিপছিপে হয়ে গিয়েছেন।

    ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের পর ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে বিজেপিকে নিয়ে সতর্ক হয়েছিল তৃণমূল। ২০১১-এর মতো ২০২১-এর বিধানসভা ভোটও পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সেই নির্বাচনের আগে ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোরকে পশ্চিমবঙ্গে নিয়ে আসেন অভিষেক। অভিষেক-পিকে জুটিই ছিল ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের অন্যতম চালিকাশক্তি। নির্বাচনের সময় টানা পরিশ্রম করেন অভিষেক। মমতার পাশাপাশি ক্রমাগত দৌড়ে বেড়ান রাজ্যের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। প্রার্থী নির্বাচনেও তাঁর বড়সড় ভূমিকা ছিল। মূলত মমতা এবং অভিষেকের উপর ভর করেই বিজেপিকে পর্যুদস্ত করে তৃণমূল।

    ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে খাতায়কলমে না হলেও অভিষেকই ছিলেন তৃণমূলের দ্বিতীয় শীর্ষ পদাধিকারী। তবে তৃণমূল ২০২১ সালে রাজ্যে তৃতীয় বার সরকার গড়ার পর অভিষেককে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক করে আক্ষরিক অর্থেই তাঁকে দলের দু’নম্বর পদে বসান মমতা। তৃণমূলে একদা তাঁর সমালোচকরাও মেনে নেন, এই দায়িত্ব এবং সম্মান অভিষেকের প্রাপ্য ছিল।

    ২০১৯ সালে দ্বিতীয় বারের জন্য সাংসদ হওয়ার পর থেকেই অভিষেকের বিরুদ্ধে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন এবং রাজ্যে বিরোধীদল বিজেপির আক্রমণের পরিমাণ বেড়েছে। রাজ্যের বিভিন্ন দুর্নীতিকাণ্ডেও তিনি জড়িত বলে অভিযোগ তুলেছে বিজেপি। এ নিয়ে তাঁকে এবং তাঁর স্ত্রী রুজিরাকে একাধিক বার তলব করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। তবে অভিষেক তলব এড়াননি। বিচলিতও হননি। জানিয়েছেন, যত বার তাঁকে ডাকা হবে, তত বার হাজিরা দিতে রাজি তিনি।

    অভিষেক যে সুবক্তা এবং সুসংগঠক, তা তাঁর কট্টর সমালোচকেরাও স্বীকার করেন। আড়ালে তাঁর সমালোচকদের কেউ কেউ এমনও মন্তব্য করেন যে, বাংলার রাজনীতিতে তিনি ‘লম্বা রেসের ঘোড়া’। তার অন্যতম কারণ হিসাবে অভিষেকের বিচক্ষণতা এবং দূরদর্শিতাকে কৃতিত্ব দেন অনেকে। অনেকের মতে, গত পাঁচ বছরে অভিষেকের বক্তৃতায় ধার বেড়েছে। ‘গর্জন’ও বেড়েছে। আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে তাঁর ভাষণ। আর সেই কারণে তাঁর জনসভায় ভিড়ও হচ্ছে চোখে পড়ার মতো। তবে তৃণমূলের অনেক নেতাদের মতে, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা এবং বক্তৃতা করার ক্ষমতা মমতার কাছ থেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন অভিষেক। আর শাসকদল হওয়ায় অভিষেকের সভায় ‘সংগঠিত ভিড়’ চোখে পড়েছে।

    গত পাঁচ বছরে তৃণমূলের প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিতে নজর কেড়েছেন অভিষেক। তাঁর বক্তৃতা আলাদা করে আলোচনার জায়গা করে দিয়েছে। গত বছরের অক্টোবরে কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগ এনে রাজভবনের অদূরে ধর্নামঞ্চে রাত কাটিয়েছিলেন অভিষেক। সেই সময় তাঁর সঙ্গে সিপিএম সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার ধর্নায় বসা মমতারও মিল পেয়েছেন অনেকে।

    রাজনীতির অলিন্দে ঘোরাফেরা রয়েছে, এমন অনেকের মতে, গত পাঁচ বছরে স্পষ্টবক্তা হিসাবেও ছাপ ফেলেছেন অভিষেক। বিরোধীদের প্রতি আক্রমণ যেমন শানিয়েছেন, তেমনই বয়সনীতি (অবসরের ঊর্ধ্বসীমা) নিয়ে তাঁর চিন্তাধারা দলের অন্দরে প্রবীণদের অখুশিও করেছে। যদিও তৃণমূলের নতুন প্রজন্মের অনেকে অভিষেকের সেই ভাবনা নিয়ে উৎসাহী। গত পাঁচ বছরে সাংগঠনিক সংস্কারের কাজও শুরু করার চেষ্টা করেছেন তৃণমূলের সেনাপতি। তৃণমূল ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য সে বিষয়েও দলের অন্দরে তাঁর সমালোচনা হয়েছে। তবে সে সব আলোচনা-সমালোচনাকে বিশেষ পাত্তা দেননি অভিষেক।

    দলের অন্দরে অভিষেকের গুরুত্ব এবং প্রভাব আরও বেশি লক্ষ্য করা গিয়েছে গত ১০ মার্চ তৃণমূলের ‘জনগর্জন’ সভা থেকে। ব্রিগেডের ওই সভা থেকে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের জন্য তৃণমূলের প্রার্থিতালিকা প্রকাশ করা হয়। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের প্রার্থিতালিকা ঘোষণা করেছিলেন মমতা। তবে ২০২৪ সালে অভিষেকের কাঁধে সেই দায়িত্ব দেন দলনেত্রী। ‘জনগর্জন’ সভার মঞ্চ থেকে একে একে তৃণমূলের ৪১ জন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেন অভিষেক। ডায়মন্ড হারবারের প্রার্থী হিসাবে অভিষেকের নাম ঘোষণা করেন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস।

    অভিষেক যে তৃণমূলের ‘জনগর্জনের’ মুখ, তা-ও প্রমাণিত ব্রিগেডের মঞ্চ থেকে। তাঁর উপস্থিতি ছিল নজরকাড়া। সেই মঞ্চ থেকে চাঁচাছোলা ভাষায় কেন্দ্রকে একের পর এক আক্রমণ করে গিয়েছেন তিনি। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের দিকে মুখোমুখি তর্কে বসার চ্যালেঞ্জও ছুড়ে দিয়েছেন সরাসরি। তৃণমূল দলের অনেক নেতাই মনে করছেন, ‘জনগর্জন’ থেকে ছক্কা হাঁকিয়েছেন অভিষেক। বক্তা হিসাবেও দশে দশ পেয়েছেন। আপাতত অভিষেক তৃতীয় বারের জন্য সাংসদ হওয়ার লড়াইয়ে নেমেছেন। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে তাঁকে ডায়মন্ড হারবারের প্রার্থী করেছে তৃণমূল। আপাতত তাঁর একটাই লক্ষ্য— ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন। একটাই দায়িত্ব— জাতীয় স্তরে বিভিন্ন রাজ্যে তৃণমূলের ভিত প্রতিষ্ঠা করা।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)