কলকাতা উত্তরের ঐতিহ্যে মেঘনাদ সাহা থেকে অজিত পাঁজা, ‘ইগো’ আসল প্রার্থী সুদীপ বনাম তাপসের যুদ্ধে
আনন্দবাজার | ৩০ মে ২০২৪
উত্তর কলকাতা মানে রসগোল্লার আঁতুড়ঘর। কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া থেকে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি। প্যারামাউন্টের সরবত থেকে কফি হাউজ়ের আড্ডা। কুমোরটুলি থেকে রাজবাড়ির শোভাবাজার। কিন্তু এই উত্তর কলকাতার মধ্যে আছে আরেকটা উত্তর কলকাতা। যেখানে মিশে রয়েছে রাজনীতির অঙ্গন। সিপিএম থেকে কংগ্রেস, ফরওয়ার্ড ব্লক থেকে বিজেপি— রাজ্যের প্রধান দল তৃণমূল (যদিও তাদের অস্থায়ী সদর দফতরের ঠিকানা এখন উত্তর কলকাতা লোকসভার ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডে) ছাড়া প্রায় সব রাজনৈতিক দলের সদর দফতর কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে।
অতীতে অনেক দলবদল দেখা শাসক তৃণমূল এই প্রথম সাক্ষী হতে চলেছে এক ভোটের, যেখানে দলের দুই দীর্ঘদিনের পতাকাবাহী সম্মুখ সমরে। সে হিসাবে বাংলায় দিল্লিবাড়ির লড়াইয়ে কলকাতা উত্তর হল ‘কুরুক্ষেত্র’।
কলকাতার উত্তর ভাগে একদা দু’টি লোকসভা আসন ছিল। কলকাতা উত্তর-পূর্ব এবং কলকাতা উত্তর-পশ্চিম। দুই আসন ভেঙেচুরে কলকাতা উত্তরের জন্ম ২০০৯ সালে। কিন্তু এর ইতিহাস প্রাচীন। ১৯৫২ সালে এই আসন থেকেই সাংসদ হয়েছিলেন বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। সাত বার সাংসদ হয়েছেন ব্যারিস্টার অশোককুমার সেন। যিনি জওহরলাল নেহরু থেকে রাজীব গান্ধীর মন্ত্রিসভায় আইনমন্ত্রক সামলেছেন। এখান থেকেই সাংসদ হয়েছেন দেবীপ্রসাদ পাল। কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি দেবীপ্রসাদ ভারতের আইনমন্ত্রীও থেকেছেন।
কলকাতা উত্তরের তৃণমূল প্রার্থী পাঁচ বারের সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় আগে এখানকারই বিধানসভা আসন বৌবাজার থেকে চার বার বিধায়ক হয়েছেন। সেটা অবশ্য কংগ্রেসের টিকিটে। সুদীপের জীবনেও কম দলবদল নেই। ১৯৯৮ এবং ১৯৯৯ সালে তৃণমূলের টিকিটে সাংসদ সুদীপ ২০০৪ সালে কংগ্রেসের সমর্থনে নির্দল প্রাথী হিসাবে লোকসভায় লড়েছিলেন। সে বার তৃণমূলপ্রার্থী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের জয়ের ‘কাঁটা’ হন তিনি। ভোটে জিতে যান সিপিএমের সুধাংশু শীল। এর পরে আবার ২০০৯ থেকে টানা তিন বার তৃণমূলের টিকিটে কলকাতা উত্তরের সাংসদ সুদীপই। আশ্চর্য নয় যে, বহরমপুরের ‘ভূমিপুত্র’ সুদীপ উত্তর কলকাতার ‘মানসপুত্র’ হয়ে উঠেছেন।
মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে উঠে আসা সুদীপ একদা ছিলেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির অনুগামী। সেই সুবাদে প্রিয়রঞ্জনের সঙ্গে কংগ্রেস ছেড়ে সামিল হয়েছিলেন কংগ্রেস (স)-তে। সেই দলের হয়ে ভোটে লড়াই করে হেরেওছিলেন। কিন্তু কংগ্রেসে ফিরে ১৯৮৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে যখন পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি হন প্রিয়রঞ্জন, তখন ‘শিষ্য’ সুদীপকে তাঁর ‘বিশ্বস্ততা’র দাম দিয়েছিলেন তিনি। সে বার বৌবাজারের বিধায়ক আব্দুল রউফ আনসারির টিকিট কেটে দিয়ে সুদীপকে প্রার্থী করেন প্রিয়। চরম বিপর্যয়ের নির্বাচনে জিতেছিলেন সুদীপ। সেই তাঁর প্রথম জনপ্রতিনিধি হওয়া। পরে অবশ্য প্রিয়-শিষ্য সুদীপ চলে আসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছাতার তলায়।১৯৯৮ এবং ১৯৯৯ সালে কলকাতা উত্তর-পশ্চিম লোকসভা থেকে জিতে সাংসদ হন। দ্বিতীয় অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারে মন্ত্রী হতে মমতাকে ‘এড়িয়ে’ সুদীপ পৌঁছে গিয়েছিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণীর অন্দরমহলে। কিন্তু শপথগ্রহণের আগেই মমতার হস্তক্ষেপে ভেস্তে যায় সুদীপের মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন। ‘দূরত্ব’ তৈরি হয় মমতা-সুদীপের। তাই ২০০৪ সালের নির্বাচনে সুদীপকে একদা ‘গুরু’ প্রিয়রঞ্জনের বিরুদ্ধে রায়গঞ্জ লোকসভায় লড়ার নির্দেশ দেন মমতা। বদলে সুদীপের আসনে প্রার্থী করা হয় কলকাতার তৎকালীন মেয়র সুব্রত মুখাপাধ্যায়কে। কিন্তু নিজের লোকসভা আসন ছেড়ে যেতে না চেয়ে দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে নির্দল প্রাথী হিসাবে মনোনয়ন দিয়ে কংগ্রেসের সমর্থন পেয়ে যান সুদীপ। সেই পদক্ষেপের জেরে তৃণমূল থেকে সাসপেন্ড করা হয় সুদীপকে। তত দিনে তৃণমূলের টিকিটে বৌবাজারের বিধায়ক হয়ে গিয়েছেন সুদীপ-জায়া নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়।
তৃণমূল থেকে সাসপেন্ড হওয়ার পর ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া মোড়ে সভা করে মমতার মুণ্ডপাত করেছিলেন সুদীপ-নয়না। সুদীপ বলেছিলেন, “আমাকে নাকি ছ’বছরের জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছে! আমি বলছি, পার্টিটা ছ’বছর থাকবে তো?” ২০০৬ সালে বৌবাজারে কংগ্রেসের হয়ে দাঁড়িয়ে বিধায়ক ছিলেন তিন বছর। আর ছ’বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই পাঁচ বছরের মাথায় বাধ্য ছেলের মতো লোকসভা ভোটের মুখে তৃণমূলে ফেরেন সুদীপ। ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে নবগঠিত কলকাতা উত্তর আসনে মহম্মদ সেলিমকে হারিয়ে তৃণমূলের লোকসভার দলনেতাও হন। সে বার তাঁর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্বের মনোবাসনাও পূরণ করে দেন মমতাই। কয়েক মাসের জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী হন সুদীপ। মাঝে বছর পাঁচেক কংগ্রেসে থাকার সময় সোমেন মিত্রের অনুগামী হয়েছিলেন অবশ্য। এ সবের মাঝে চিটফান্ড কেলেঙ্কারিতে যুক্ত থাকার অভিযোগে ১৩৬ দিনের কারাবাসও করেছেন।
এ বারের লোকসভা ভোটে সুদীপের প্রধান প্রতিপক্ষ অধুনা বিজেপির তাপস রায় দিল্লিবাড়ির লড়াইয়ের তৃতীয় ঘন্টা পড়ার আগে পর্যন্তও তৃণমূলেই ছিলেন। ঘাসফুল প্রতীকে চার বারের বিধায়ক তাপস প্রথম জিতেছিলেন ১৯৯৬ সালে বিদ্যাসাগর কেন্দ্র থেকে। বিধানসভা ভোটের আগে আগে যোগ দিয়েছিলেন তৃণমূলে। ২০০১ সালে বড়বাজার আসন থেকে তৃণমূলের প্রতীকে ভোটে দাঁড়িয়ে জেতেন তিনি। যদিও তার আগে কলকাতা পুরসভার ৪৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে জয়ী হয়ে কাউন্সিলর হন ছাত্রনেতা তাপস। কিন্তু ২০০৬ সালে বড়বাজার আসনে লড়ে তৃতীয় হয়ে যান। সে বার ওই আসন জিতেছিলেন লালুপ্রসাদ যাদবের আরজেডি-র প্রার্থী মহম্মদ সোহরাব। ২০১১ সালে প্রথম দিকে তাপসের নাম বেলেঘাটা বিধানসভার প্রার্থী হিসাবে বিবেচিত হলেও একেবারে শেষমুহূর্তে তাঁকে প্রার্থী করা হয় বরাহনগর থেকে। সেই থেকে তিনি পর পর তিন বার জিতেছেন বরাহনগরে। কিন্তু ভোটের মুখে ফুলবদলে তাপস এ বার পদ্মের প্রার্থী। তিনি প্রার্থী হওয়ায় তৃণমূল প্রার্থী সুদীপকে এ বার গত দু’বারের নিরিখে অতিরিক্ত ঘাম ঝরাতে হচ্ছে। এমনকি, প্রচারে এসে মমতাকেও বলতে হয়েছে, এই নির্বাচনই সুদীপের শেষ নির্বাচন হতে পারে। তাই তাঁকেই এ বার ভোট দিক উত্তর কলকাতার জনতা।
ফুলবদল একেবারে ভোটের মুখে মুখে হলেও তা যে অবশ্যম্ভাবী, তা টের পাওয়া গিয়েছিল আগেই। তৃণমূলের অন্দরে সুদীপ বনাম তাপস লড়াই অনেক দিনের। আবার সুদীপকে নিয়ে প্রবীণ বনাম নবীন লড়াইও ছিল ঘাসফুল শিবিরে। মাঝে সেই লড়াইয়ে ঢুকে পড়েছিলেন দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ। ভোটের মধ্যেও সে কাহিনি চলেছে। সে সব লড়াই তৃণমূল সুচারু ভাবে সামলে নিয়েছে ঠিকই। কিন্তু সুদীপের লড়াইয়ে যে উত্তর কলকাতার তৃণমূল পুরোপুরি নেই, তা দলের নেতারাও জানেন। ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে, সুদীপের কেন্দ্রে প্রচারে দেখা যায়নি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
তৃণমূলের অন্দরের এই লড়াই সদ্য দল বদলানো তাপসকে কতটা ‘সুবিধা’ দেবে, সে প্রশ্ন নিয়েই দিল্লিবাড়ির লড়াইয়ে নেমেছে কলকাতা উত্তর। অনেকেই বলছেন, এই আসনের ভোটে দুই প্রধান প্রতিপক্ষের মাঝে আসল প্রার্থী হয়ে রয়েছে ‘ইগো’। যে অভিমান ভোটের বাক্সে প্রভাব ফেললেও ফেলতে পারে। তবে ভোটের অঙ্কে বিজেপি খুব সুবিধাজনক জায়গায় নেই। ২০০৯ সালেও বিজেপি প্রার্থী তথাগত রায় তৃতীয় স্থানে ছিলেন মাত্র ৪.২২ শতাংশ ভোট পেয়ে। দ্বিতীয় হয়েছিলেন এই আসনে ২০০৪ সালে সাংসদ হওয়া সিপিএমের সেলিম। তার আগে চার বার কংগ্রেস এবং দু’বার তৃণমূলের টিকিটে সাংসদ হয়েছেন অজিত পাঁজা। যিনি অতীতে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতিও হয়েছিলেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মন্ত্রকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও থেকেছেন। যদিও সেই লোকসভা কেন্দ্রের নাম ছিল কলকাতা উত্তর-পূর্ব।
২০১৪ এবং ২০১৯ সালে সুদীপের পিছনে থেকে দ্বিতীয় হয়েছিলেন বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। তবে দু’বারেই ভোট বেড়েছিল পদ্মের। প্রথম বার রাহুল পান ২০ শতাংশ ভোট। পরের বারে প্রায় ৩৭ শতাংশ। সুদীপের শেষ জয় এসেছিল ১ লাখ ২৭ হাজার ভোটে। এই অঙ্ক নিয়েই তৃণমূল এ বারের ভোটে। এই আসনের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভাই ঘাসফুলের। তবে কলকাতা উত্তরের তিনটি ওয়ার্ড (বড়বাজার এলাকার ২২, ২৩ এবং বৌবাজার এলাকার ৫০ নম্বর ওয়ার্ড) বিজেপির দখলে। তাপসের পক্ষে এই তিন ওয়ার্ডে পদ্মের কাউন্সিলর থাকা ছাড়াও কিছু বাড়তি সুবিধা রয়েছে। এই আসনে মুসলিমদের বসবাস থাকলেও প্রায় ৩৯ শতাংশ ভোটার হিন্দিভাষী হিন্দু। ঘটনাচক্রে, অযোধ্যায় নতুন রামমন্দির উদ্বোধনে কলকাতায় যা কিছু উৎসব হয়েছিল, তা মূলত এই কলকাতা উত্তরের রামমন্দিরকে ঘিরেই।
এই আসনে জোটের হয়ে প্রার্থী ইতিমধ্যে রাজনীতির সবকিছুর স্বাদ পাওয়া প্রদীপ ভট্টাচার্য। যিনি অতীতে বিধায়ক হয়েছেন, লোকসভায় গিয়েছেন, কেন্দ্রের মন্ত্রী হয়েছেন, রাজ্যসভার সাংসদও হয়েছেন। এমনকি, বছর তিনেক প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতিও থেকেছেন। প্রবীণ প্রদীপের হয়ে প্রচারে নেমেছেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বর্ষীয়ান বিমান বসুও। তবে প্রদীপের লড়াইয়ের রসদ খুবই কম। তুলনায় সুদীপ অনেক বেশি উজ্জ্বল। ২০১৯ সালেই সুদীপ পেয়েছিলেন প্রায় ৫০ শতাংশ ভোট। সেখানে বাম-কংগ্রেস মিলিয়ে ভোট ছিল ১০ শতাংশের মতো।
কলকাতা উত্তরের ভোটে রামমন্দিরের অস্তিত্ব রয়েছে। গত বছর দুর্গাপুজোয় সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারে বিজেপি নেতা সজল ঘোষের রামমন্দিরের আদলে মন্ডপের কথাও বলছেন অনেকে। তবে কলকাতা উত্তর আসলে কালীর। ঠনঠনে থেকে পুটেশ্বরী, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি থেকে ফাটা কেষ্টর কালী এই লোকসভাতেই। আবার স্বামী বিবেকানন্দের ভিটে, মায়ের (সারদাদেবী) বাড়িও এখানে। রামকৃষ্ণের স্মৃতিবিজড়িত বলরাম বসুর বাড়ি থেকে কাশীপুর উদ্যানবাটি সবই এই কেন্দ্রের মধ্যে। ঐতিহ্যশালী এই আসনে কি মমতার ‘সন্ন্যাসী’ বিতর্ক ছায়া ফেলতে পারে? সেই লক্ষ্যেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও ‘ঐতিহ্য’ ছুঁয়ে গিয়েছেন এই কেন্দ্রে প্রচারে এসে।
সব কিছু দেখেশুনে আমজনতার ইভিএমের বোতাম ছোঁয়ার দিন জুনস্য প্রথম দিবসে।