সন্দেশখালি। বাংলার কাছেও প্রায় অচেনা এই নাম এখন গোটা দেশের চেনা। সৌজন্যে লোকসভা নির্বাচন। যার জেরে দিল্লিবাড়ির লড়াইয়ে ‘ভিআইপি’ আসন বসিরহাট আর নিছক ‘হাট’ নয়, বিশাল এক ‘শপিং মল’।
সেই বিশাল ‘বিপণি’তে নানা বিতর্কের জোগান। চাষের জমি দখল, নোনা জল ঢুকিয়ে দেওয়া, মাছের ভেড়ি, মধ্যরাতে পিঠে বানানোর আমন্ত্রণ, নারী নির্যাতনের অভিযোগ, মহিলাদের বিক্ষোভ, বিজেপির অভিযান, সিপিএমের জেগে ওঠা, ইডির উপর হানা, শিবু হাজরা, উত্তম সর্দার, সিবিআই, রাজীব কুমার, শেখ শাহজাহান, এনআইএ, অস্ত্র উদ্ধার। যার একেবারে শেষে রেখা পাত্র। সন্দেশখালিতে নির্যাতনের অভিযোগ তোলা বধূকে লোকসভা ভোটে প্রার্থী করে ‘কিস্তিমাত’ করতে চেয়েছে বিজেপি। এর পরে এসেছে সন্দেশখালির ‘চক্রান্ত’ ফাঁস করার ‘স্টিং ভিডিয়ো’। ফলে বসিরহাটে ভোটের বাজার আরও চনমনে।
বারাসতের দক্ষিণে উত্তর ২৪ পরগনার এই আসনের এক দিকে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলা আর নীচের দিকে সুন্দরবন। চাষের মাঠ, আর মাছের ভেড়িতে ভরা এই আসনের নাম আগে বাংলাতেও এত কাল ‘অচেনা’ ছিল। কিন্তু এখন গোটা দেশের ‘চেনা’। বসিরহাট নয়, সন্দেশখালি বিধানসভার কথা গোটা রাজ্যে প্রচারে ব্যবহার করেছে বিজেপি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাংলায় তো বটেই, অন্য রাজ্যে প্রচারেও বার বার তৃণমূলকে আক্রমণ করতে গিয়ে সন্দেশখালির নাম নিয়েছেন। সেই ঘটনায় প্রধান অভিযুক্তের নাম যে হেতু শেখ শাহজাহান, তাই ‘মেরুকরণ’-এর অস্ত্রও হয়েছে সন্দেশখালি তথা বসিরহাট।
স্বাধীনতার পর পর সব নির্বাচনে কংগ্রেসের আধিপত্য দেখা গেলেও ১৯৮০ সাল থেকে সিপিআইয়ের হয়ে যায় বসিরহাট। প্রথম জেতেন ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত। পরে কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও হয়েছিলেন ইন্দ্রজিৎ। তবে তখন তিনি সাংসদ ছিলেন মেদিনীপুর আসনের। বসিরহাট আসনে বাম প্রার্থী হিসাবে সর্বশেষ সাংসদ হয়েছিলেন অজয় চক্রবর্তী। ২০০৪ সাল পর্যন্ত টানা চার বার জিতেছিলেন তিনি। ২০০৯ সালে এল বদল। জিতলেন তৃণমূলের হাজি নুরুল ইসলাম। পঞ্চায়েত স্তর থেকে জেলা পরিষদ পর্যন্ত জনপ্রতিনিধি হওয়া ছোট জাগুলিয়ার বাসিন্দা নুরুলকে প্রার্থী করে সাফল্য পেয়েছিলেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সিপিআইয়ের থেকে প্রায় ৫৯ হাজার ভোট বেশি পেয়ে বসিরহাট জিতেছিলেন নুরুল। সেই সময় তিনি ছিলেন উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের বিরোধী দলনেতা।
বসিরহাটে নুরুলের জয় বাংলার রাজনীতিতে সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক তৃণমূলের ঝুলিতে আসার ইঙ্গিত স্পষ্ট করেছিল। কারণ, ২০০৯ সালে বসিরহাটের ভোটে সিপিআইয়ের প্রার্থী অজয় বনাম হাজি নুরুলের মধ্যে লড়াইয়ে তৃতীয় পক্ষ হয়েছিলেন সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী। যিনি বর্তমানে মমতা মন্ত্রিসভার সদস্য। সেই সময় তিনি ‘তালাচাবি’ প্রতীক নিয়ে পিডিসিআই প্রার্থী হিসাবে বসিরহাটে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত ওই লোকসভায় ৪১ হাজার ভোট পেলেও নুরুলের জয় রুখতে পারেননি সিদ্দিকুল্লাহ।
তবে তার পাঁচ বছর পরে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বসিরহাটে প্রার্থী বদল করেন তৃণমূলের সর্ব্বোচ্চ নেত্রী। কলকাতা থেকে বসিরহাট আসনে লড়াইয়ের জন্য পাঠানো হয় তৃণমূলের বিতর্কিত আইনজীবী নেতা ইদ্রিশ আলিকে। আর নুরুলকে পাঠানো হয় তুলনামূলক ‘কঠিন’ আসন জঙ্গিপুরে। অসমর্থিত তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছিল, ২০১১ সালে দেগঙ্গা এলাকায় একটি গোষ্ঠী সংঘর্ষের ঘটনায় তাঁর নাম যুক্ত হওয়াতেই তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব বসিরহাটের প্রার্থী বদল করেন।
তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পুত্র অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছিলেন নুরুল। কিন্তু সংসদে যেতে পারেননি। তৃতীয় স্থানে শেষ করলেও সেই বার প্রথম জঙ্গিপুর আসনে দু’লাখের বেশি ভোট পায় তৃণমূল।
তবে ২০১৬ সালে বসিরহাট লোকসভার অধীন হাড়োয়া বিধানসভার তৎকালীন তৃণমূল বিধায়ক জুলফিকার আলিকে টিকিট না দিয়ে সেখানে নুরুলকে প্রার্থী করেন মমতা। ২০১১ সালে মাত্র ১২০০ ভোটে জেতা আসনটি নুরুল জেতেন ৪৩ হাজারেরও বেশি ভোটে। ২০২১ সালেও ওই আসন থেকে জিতেছিলেন তিনি। এরই মধ্যে আসে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোট। ফের বসিরহাটে প্রার্থী বদল করে তৃণমূল। ২০১৪ সালে যে ইদ্রিশকে বসিরহাট লোকসভায় প্রার্থী করেছিলেন, তাঁকে উলুবেড়িয়া পূর্ব বিধানসভার উপনির্বাচনে প্রার্থী করে দেন মমতা। সকলকে চমকে দিয়ে বসিরহাটে প্রার্থী করেন তারকা অভিনেত্রী নুসরত জাহানকে। তৃণমূলের জয়ের ব্যবধান সাড়ে তিন লাখ ছাপিয়ে যায়। তবে এ বার যে নুসরতকে প্রার্থী করা হবে না, তা অনেক আগে থেকেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। মমতার ইচ্ছাতেই বসিরহাট লোকসভায় শেষ পর্যন্ত তৃণমূলের প্রাথী হয়েছেন সেই নুরুল। হজ কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে নুরুলের রিপোর্ট কার্ডও দিদির কাছে গুরুত্ব পেয়েছিল। তবে নুরুল প্রার্থী হিসাবে বসিরহাটের তৃণমূল কর্মীদের কাছে ‘গ্রহণযোগ্য’ হলেও তাঁর অসুস্থতা ভাবাচ্ছে স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বকে।
অঙ্কের হিসাবে নুরুলের লড়াই সহজ। গত লোকসভা ভোটে সাতটি বিধানসভাতেই বড় ব্যবধানে এগিয়ে ছিল তৃণমূল। পরে নীলবাড়ির লড়াইয়েও সাতটিই দখল করেছিল। তবু চিন্তা রয়েছে। যে চিন্তার সূচনা হয়েছিল ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে। সে বার বিজেপি প্রার্থী (বর্তমান রাজ্যসভার সাংসদ) শমীক ভট্টাচার্য বসিরহাটের ভোটে তৃতীয় হলেও একটি বিধানসভা আসনে এগিয়ে যান। বসিরহাট দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রে প্রায় ৩২ হাজার ভোটে এগিয়ে ছিল বিজেপি। সেই বছরেই ওই আসনের বিধায়ক নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে উপনির্বাচন হয়। তৃণমূল প্রার্থী করে ফুটবলার দীপেন্দু বিশ্বাসকে। রাজ্যে প্রথম বার একক শক্তিতে বিজেপির বিধায়ক হন শমীক। যদিও দীপেন্দুর কাছেই ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে পরাজিত হন তিনি।
সেই সময়ে বসিরহাট দক্ষিণে বিজেপির ভোট ৩০ শতাংশে পৌঁছলেও ২০২১ সালের নীলবাড়ির লড়াইয়ে বড় ব্যবধানেই জিতেছিলেন তৃণমূলের সপ্তর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়। গত লোকসভা নির্বাচনেই বিজেপি শমীককে দমদম আসনে পাঠিয়ে বসিরহাটে প্রার্থী করেছিল তখন দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসুকে। এ বার রাজ্য বিজেপির কোনও পদে না থাকা সায়ন্তন রাজনীতি থেকে দূরেই আছেন। তাই এই ‘কঠিন’ আসনে কাকে প্রার্থী করা হবে, তা নিয়ে বিজেপি চিন্তায় ছিল। সেই চিন্তা মিটিয়ে দেয় সন্দেশখালির ‘উত্তাপ’। সেখান থেকেই ‘মুখ’ খুঁজে নেয় বসিরহাটে ‘মুখহীন’ বিজেপি। পদ্মশিবির সূত্রে এমন দাবিও করা হয়েছে যে, কোনও ‘নির্যাতিতা’কে প্রার্থী করার কথা বলেছিলেন স্বয়ং মোদী। সেই নির্দেশ পেয়েই রেখার খোঁজ এবং প্রার্থী হিসাবে তাঁর নাম ঘোষণা। পরে রেখাকে সরাসরি ফোন করে কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। বারাসতের সভায় রেখার বক্তব্য শুনে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। একই সঙ্গে আশা প্রকাশ করেন এই বলে যে, রেখার মতো ‘প্রান্তজন’ লোকসভায় আসুন।
যে আসন থেকে ‘মেরুকরণ’-এর স্বর উঠেছে গোটা রাজ্যে, সেই বসিরহাটের সব অঙ্কই ধর্মকে ঘিরে। এই আসনে মুসলিম ভোট ৬০ শতাংশের আশপাশে। সেই ভোট একচেটিয়া তৃণমূলের থাকবে কি না, সে প্রশ্ন থাকলেও হিন্দু ভোটের পুরোটাই বিজেপির পক্ষে যাবেই, এমনও বলা যায় না। বাদুড়িয়া, হাড়োয়া, মিনাখাঁ, বসিরহাট উত্তরে তৃণমূলের শক্তি যথেষ্ট। মিনাখাঁর বিধায়ক ঊষারানি মণ্ডলের সঙ্গে দলের দূরত্ব তৈরি হলেও শেষে তা মিটিয়ে ফেলেছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
শক্তি আছে। কিন্তু শঙ্কাও আছে শাসকের। কারণ, এই আসনে মুসলিম ভোটে ভাগ বসানোর জন্য ময়দানে রয়েছে সিপিএম। তৃণমূল শিবিরের অবশ্য দাবি, বিরোধী ভোট কেটে বিজেপির ‘যাত্রাভঙ্গ’ করবে সিপিএম। বামফ্রন্টের তরফে এই আসনে বরাবর লড়াই করে এসেছে সিপিআই। কিন্তু এ বার সেই আসনে সিপিএম। ২০১১ সালে সিপিএমের ভরাডুবিতেও সন্দেশখালিতে জিতেছিলেন সিপিএমের নিরাপদ সর্দার। তিনিই এ বারের বামপ্রার্থী। সন্দেশখালিতে গোলমালের সময়ে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল নিরাপদকে। ফলে ২০১৯ সালে ৫ শতাংশেরও কম ভোট পাওয়া বামেরা না হলেও বসিরহাট আসনে নিরাপদ ‘প্রাসঙ্গিক’। তবে নওশাদ সিদ্দিকির দল আইএসএফও এই আসনে প্রার্থী দিয়েছে।
তৃণমূলের কাছে নিরাপদ নয় আইএসএফ। ‘খাম’ প্রতীকে বসিরহাটে প্রার্থী হয়েছেন আখতার রহমান বিশ্বাস। দল তৈরির পরে এই প্রথম লোকসভা নির্বাচন। তাই বিধানসভা ভোটের ফলই এখানে বিবেচ্য। নীলবাড়ির লড়াইয়ে সংযুক্ত মোর্চার শরিক হিসাবে বসিরহাট লোকসভার তিনটি বিধানসভা আসনে প্রার্থী দিয়েছিল আইএসএফ। সন্দেশখালি, হাড়োয়া এবং বসিরহাট উত্তরে। সন্দেশখালিতে আইএসএফ ৬.৯৯ শতাংশ ভোট পেলেও বাকি দু’টিতে ভোটপ্রাপ্তি ছিল ২০ শতাংশের উপরে। তবে শাসকের কাছে সবচেয়ে বেশি চাপের হতে পারে হাবড়ার বিধায়ক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ও শাহজাহানের অনুপস্থিতি। একসময় জ্যোতিপ্রিয় নিজের হাতে গড়েছিলেন বসিরহাটের সংগঠন। তাঁর হাত ধরেই সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে এসেছিলেন শাহজাহান-সহ তাঁর বাহিনী। যিনি জেলে বসেও দিল্লিবাড়ির লড়াইয়ে প্রাসঙ্গিক।