• হাওয়া বদলেই জয় বদলায় জয়নগরে, তাতেই তৃণমূলের প্রতিমায় প্রাণপ্রতিষ্ঠা, পদ্মের কান্ডারি অশোক তবু আশায়
    আনন্দবাজার | ৩১ মে ২০২৪
  • হতে পারে বঙ্গোপসাগরের কাছে। তবু দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগরের পালে রাজনীতির হাওয়াবদল প্রভাব ফেলে। দিল্লি নয়, রাজ্য রাজনীতির হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই বদলেছে জয়নগরের জয়-পরাজয়।

    স্বাধীনতার পরে কংগ্রেস। ১৯৭৭ সালে জনতা পার্টি। তবে মাঝে এক বার জিতেছিল এসইউসিআই। বাংলার এই আসনে সাংগঠনিক শক্তিতে শিবদাস ঘোষের দল বরাবরই অন্য জায়গার তুলনায় শক্তিশালী। আবার বামেদের দখলে জয়নগর ছিল ১৯৮০ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পরেও এখানে সহজে জিতেছিল বামেরা। তবে সিপিএম নয়, প্রথম থেকে এখনও পর্যন্ত আরএসপি-ই জয়নগরের বামশক্তি। এই আসনে ২৯ বছর সাংসদ ছিলেন আরএসপি-র সনৎ মণ্ডল। তবে ২০০৯ সালে জয়নগরে প্রার্থী বদলের সিদ্ধান্ত নেয় আরএসপি। বর্ষীয়ান সনৎকে সরিয়ে টিকিট দেওয়া হয় জেলা পরিষদের প্রাক্তন সহ-সভাধিপতি নিমাই বর্মণকে। তিনি হারেন এসইউসিআইয়ের চিকিৎসক প্রার্থী তরুণ মণ্ডলের কাছে। সেই থেকেই জয়নগরের রাজনীতিতে দাপট কমতে শুরু করে আরএসপি-র।

    বামফ্রন্টের জোটশরিক হয়েও বাসন্তী, গোসাবায় সিপিএমের বিরুদ্ধে চোখে চোখ রেখে লড়াই করত আরএসপি। গণেশ মণ্ডল, সুভাষ নস্কর, চন্দ্রশেখর দেবনাথ, লোকমান মোল্লার মতো নেতা আরএসপি-কে উপহার দিয়েছিল জয়নগর লোকসভা। কিন্তু কালের নিয়মে এই সব নেতারা এখন শক্তিহীন। সুদিন নেই আরএসপি-র।

    তৃণমূল এখন এই আসন দখল করলেও সহজে তা হয়নি। জয়নগরে বিজেপি দ্বিতীয় স্থানে ছিল ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত। তখন অবশ্য ঘাসফুলের সঙ্গে জোট ছিল পদ্মফুলের। এর পরে ২০০৯ সালে তৃণমূল জোট গড়ে এসইউসিআই এবং কংগ্রেসের সঙ্গে। তবে এসইউসিআই তৃণমূলকে মেনে নিলেও কংগ্রেসকে মানতে চায়নি। শেষ পর্যন্ত অবশ্য জয়নগরে কংগ্রেস প্রার্থী দেয়নি। ‘জোটের প্রার্থী’ হিসাবেই জিতেছিলেন এসইউসিআইয়ের তরুণ। সে বারই ভোট চলে গিয়েছিল প্রায় ৪৯ শতাংশে। দ্বিতীয় আরএসপি-র তখনও প্রায় ৪৩ শতাংশ ভোট রয়েছে। আর ‘একলা’ বিজেপির দেড় শতাংশের মতো।

    মধুচন্দ্রিমা পর্ব মিটতে না মিটতেই তৃণমূল-এসইউসিআই সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। রাজ্যে পালাবদলের পরে জয়নগরের পালেও সেই হাওয়া লেগেছিল। ২০১৪ সালে তৃণমূল একাই লড়ে। লক্ষাধিক ভোটে জেতেন প্রতিমা মণ্ডল। জয়নগরের প্রতিমায় ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’ হয়ে যায় তৃণমূলের। তিনে চলে যায় এসইউসিআই। ২০১৯ সালে আরও ব্যবধান বাড়িয়ে জেতেন প্রতিমা। ১৪.৪২ শতাংশ ভোট বাড়িয়ে তৃণমূল পায় ৫৬ শতাংশের বেশি ভোট। বিজেপিও ২৩.২৩ শতাংশ ভোট বাড়িয়ে দ্বিতীয় স্থানে যায়। তাদের প্রার্থী ছিলেন চিকিৎসক অশোক কান্ডারি। চারে পৌঁছে যায় এসইউসিআই। তিনে আরএসপি। তৃণমূল জিতেছিল ৩ লাখ ১৬ হাজারেরও বেশি ভোটে। শরিকি দ্বন্দ্বের মধ্যেও আরএসপি-কে জেতাতে প্রাণপাত করত সিপিএম। জয়নগর দখলে রাখতে আরএসপি-কে যোগ্য সঙ্গত করতেন তৎকালীন সিপিএম (অধুনা তৃণমূল) নেতা রেজ্জাক মোল্লা। ক্যানিং পূর্বের বিধায়ক হিসাবে কয়েক হাজার ভোটে আরএসপি প্রার্থীকে এগিয়ে দিতেন রেজ্জাক।

    আরও এক নেতার কথা না বললে জয়নগরের কাহিনি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তিনি বর্তমানে ক্যানিং পূর্বের বিধায়ক শওকত মোল্লা। যিনি বামফ্রন্ট জমানায় ছিলেন ক্যানিং-২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি। তৃণমূল ‘পেটাতে’ সিদ্ধহস্ত বলে খ্যাত এই নেতার ক্যানিংয়ের রাজনীতিতে দাপট তখন থেকেই। ১৯৯৮-২০১১ পর্যন্ত ক্যানিং এলাকায় যত তৃণমূল নেতা খুন-জখম হয়েছিলেন, তার ৯০ শতাংশ অভিযোগ উঠত শওকতেরই বিরুদ্ধে। লোকসভা ভোটে আরএসপি প্রার্থীকে জেতাতে তাঁর ‘অবদান’ ছিল উল্লেখযোগ্য। তবে সিপিএম কোনও দিন পঞ্চায়েত স্তরের বেশি তাঁকে উঠতে দেয়নি তাঁকে।

    ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটেও ক্যানিং পূর্বে সিপিএমের প্রার্থী রেজ্জাককে জেতাতে বিরাট ভূমিকা ছিল শওকতের। কিন্তু রাজ্যে পালাবদলের পরে তৃণমূলে যোগ দিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন তিনি। নিয়মিত তৃণমূল নেতাদের বাড়িতে ধর্না দেওয়া শুরু করেন। শেষে মুকুল রায়ের হাতযশে তৃণমূলে ঢোকার সুযোগ পান। তৃণমূলের অলিন্দে ক্ষমতার রাজনীতির সমীকরণে সহজেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আস্থাভাজন’ হয়ে ওঠেন শওকত। ফলস্বরূপ ২০১৬ সালে ক্যানিং পূর্ব আসন থেকে তৃণমূলের হয়ে টিকিট পান তিনি। জেতেনও।

    এ বারের লোকসভা ভোটেও প্রতিমাকে জয়ী করতে শওকতই তৃণমূলের বড় ভরসা। কারণ, বাম জমানা হোক বা তৃণমূল, শওকত সর্বদা থেকেছেন শাসকদলের ‘শক্তিমান’ হয়েই। একদা তাঁর বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া তৃণমূল নেতারা হয় শওকতকেই নেতা মেনে নিয়ে তাঁর নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছেন, নয়তো রাজনীতি থেকে কয়েকশো যোজন দূরে ছিটকে গিয়েছেন।

    এমন নানা অঙ্কের অতীত-বর্তমান নিয়ে এ বারের দিল্লিবাড়ির লড়াইয়ে জয়নগর। বাকি সব দল এক থাকলেও বামেদের সঙ্গে জোট হওয়ায় প্রার্থী দেয়নি কংগ্রেস। তার বদলে এসেছে নতুন দল আইএসএফ। এ বারেও তৃণমূলের বাজি প্রাক্তন আমলা প্রতিমাই। ডব্লিউবিসিএস প্রতিমার রাজনীতিতে আসা ২০১৪ সালে। তাঁর পিতা গোবিন্দচন্দ্র নস্কর অতীতে কংগ্রেসের টিকিটে দু’বার ক্যানিং পশ্চিমের বিধায়ক হয়েছিলেন। বনগাঁ লোকসভা আসনে তিনিই তৃণমূলের খাতা খুলেছিলেন। ২০০৯ সালে সিপিএমের অসীম বালাকে হারিয়ে সংসদে যান। কিন্তু পরের বার ২০১৪ সালে মতুয়া ভোটকে টেনে আনতে তৃণমূলনেত্রী ঠাকুরবাড়ির সদস্যকে প্রার্থী করেন। বীণাপাণি দেবীর (বড়মা) পুত্র কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরকে প্রার্থী করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বনগাঁ লোকসভায় গোবিন্দচন্দ্রকে টিকিট না দিলেও জয়নগর লোকসভায় তাঁর কন্যা প্রতিমাকে প্রার্থী করেন মমতা। পরে ২০১৬ সালে গোবিন্দচন্দ্রকে বাসন্তী আসন থেকে বিধায়ক করে তৃণমূল।

    জয়নগরের লড়াইয়ে বিজেপির বড় ‘ভরসা’ তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। গোসাবা, বাসন্তী, কুলতলি, জয়নগর— সব বিধানসভা এলাকাতেই নিজেদের মধ্যে কিছু না কিছু গোলমাল রয়েছে। একই অবস্থা ক্যানিং পূর্ব, পশ্চিম এবং মগরাহাট পূর্বেও। তবে গত লোকসভা নির্বাচনের মতোই গত বিধানসভা নির্বাচনেও সাতটি কেন্দ্রেই জিতে রয়েছে তৃণমূল। ভোটের মুখে ‘গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব’ অনেকটা সামলাতেও পেরেছেন জেলানেতৃত্ব। তবে সব সংঘাত তো মেটে না। তলে তলে রয়েও যায়। সে সব ভোটে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন শাসক শিবিরের নেতারা। তবে গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট দিতে না পারার অভিযোগ কমবেশি রয়েছে গোটা লোকসভা এলাকাতেই। তাকেই কাজে লাগাতে চান বিজেপির ‘কান্ডারি’ অশোক। প্রতিমা অবশ্য বলছেন, তাঁর লক্ষ্য জয়ের ব্যবধান বাড়ানো।

    জল-জঙ্গলের জয়নগরের সমস্যাগুলো আলাদা। নদীবাঁধ থেকে নোনা জলে শস্য নষ্ট হওয়ার যাতনা রয়েছে এখানে। বিরোধীরা সে সব নিয়েই আক্রমণ শানাচ্ছে। আরএসপি প্রার্থী সমরেন্দ্রনাথ মণ্ডল এবং এসইউসিআই প্রার্থী নিরঞ্জন নস্কর কার ভোট কতটা কাটতে পারবেন বা আদৌ পারবেন কি না, তা নিয়ে খানিক চর্চা রয়েছে। তবে সেটাও নিমিত্ত মাত্র। কারণ, গত নির্বাচনের ফলাফলের নিরিখে দুই দলের পুঁজি যথাক্রমে ২.২৮ এবং ১.৩৮ শতাংশ ভোট। আইএসএফ প্রার্থী জানেনই না জয়নগরের কোথায় কত জল! প্রথম বার কতটা ভোট খামে ভরা যাবে, আপাতত সেটাই দেখতে চায় প্রায় ৩৬ শতাংশ মুসলিম ভোটারের জয়নগর।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)