• দুই নায়কের যুদ্ধে ঘাটাল দেবভূমি থাকবে কি? জানে সিপিএমের শেষপুর, পদ্ম ছকে রেখেছে মাস্টারপ্ল্যান
    আনন্দবাজার | ৩১ মে ২০২৪
  • ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যান! যুগ যুগ ধরে যে কোনও নির্বাচনে ‘ইস্যু’! কত দশক পূর্ণ হল, বলতে পারবেন ইতিহাসবিদেরা। প্রজন্মের পরে প্রজন্ম ধরে শিলাবতীর জলে ভাসমান ঘাটালের বাসিন্দারা শুনে আসছেন, এক দিন ঠিক ‘বিপ্লব’ আসবে! অলীক মাস্টারপ্ল্যান কার্যকরের ছবি দেখা যাবে কোনও এক ঘুম-ভাঙা সকালে। কিন্তু তা নিয়ে সরকারের ঘুম ভাঙেনি এখনও।

    ঘাটালে মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে অনেক রসিকতা চালু রয়েছে। তবু দু’বারের সাংসদ দীপক অধিকারী (দেব) স্বপ্ন দেখাচ্ছেন ঘাটালবাসীকে। এ বারেও প্রথমে ভোটে দাঁড়াতে নারাজ দেব প্রার্থী হওয়ার পরে জানিয়েছেন, রাজ্য সরকার ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যান কার্যকর করবে— এমন প্রতিশ্রুতি পেয়েই তিনি ভোটে লড়তে রাজি হয়েছেন। দিদি (মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) তাঁকে ‘হ্যাঁ’ বলার পরেই তৃণমূলের হয়ে তৃতীয় বারের লড়াইয়ে সম্মতি দিয়েছেন। প্রসঙ্গত, প্রার্থিতালিকা ঘোষণার আগেই মমতা দেবকে পাশে নিয়ে জানিয়েছিলেন, কেন্দ্রের ভরসায় না-থেকে ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যানের কাজ করে দেবে রাজ্যই। মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে দেব নিজেও এতটাই জড়িয়ে পড়েছেন যে, ভোটের প্রচারে বলছেন, ‘‘এর জন্য যদি আরও একটা জন্ম নিতে হয় তো নেব! ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়িত করার জন্য দরকারে আবার জন্ম নেব।’’ অন্য দিকে, বিজেপির ‘হিরো’ হিরণ বলছেন, ‘‘সাংসদ গত ১০ বছরে ঘাটালে কোনও কাজই করেননি।’’

    পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল লোকসভার নাম এককালে ছিল পাঁশকুড়া। তারও আগে আবার এটির নাম ছিল ‘ঘাটাল’ই। নামবদলের এই লোকসভা আসন ক্ষমতাবদলও দেখেছে। একটা সময়ে পাঁশকুড়া পূর্ব নামে বিধানসভা আসনও ছিল। সেখানে ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত টানা বিধায়ক ছিলেন সিপিআইয়ের গীতা মুখোপাধ্যায়। চার বার বিধানসভা নির্বাচনে জেতার পরে ১৯৮০ সালে পাঁশকুড়া লোকসভায় প্রার্থী হন গীতা। জেতেন টানা সাত বার। ২০০০ সালে সাংসদ থাকা অবস্থাতেই প্রয়াত হন গীতা। আর সে বার পাঁশকুড়ায় উপনির্বাচনে জিতে যায় তৃণমূল! তখনও সেখানে বিশেষ সংগঠন ছিল না ঘাসফুলের। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রাক্তন আমলা বিক্রম সরকার জেতেন। তিনি হারিয়েছিলেন সিপিআইয়ের প্রতাপশালী নেতা গুরুদাস দাশগুপ্তকে। সে বার ‘চুপচাপ ফুলে ছাপ’ স্লোগান উঠেছিল তৃণমূলের পক্ষে। সেই জয় মেদিনীপুর জেলায় একটি একটি করে এলাকায় তৃণমূলের শক্তিবৃদ্ধির সূচনা করে। যে কারণে ওই জয়কে সেই সময়ে ‘পাঁশকুড়া লাইন’ নাম দেওয়া হয়েছিল। ২০০৪ সালে অবশ্য আবার গুরুদাস প্রার্থী হয়ে জেতেন। আসনটি আবার সিপিআইয়ের দখলে চলে যায়।

    পশ্চিম মেদিনীপুরের অন্য আসনগুলির সঙ্গে ঘাটালও রাজ্য রাজনীতিকে একটি বার্তা দিয়েছে যে, ‘চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়’। সেটা শুধু ঘাটাল লোকসভা আসনেই নয়। এই এলাকার বিভিন্ন বিধানসভা আসনেও দেখা গিয়েছে। এককালে যাঁরা ‘রাজাধিরাজ’ ছিলেন, তাঁদেরই ভিক্ষা চাওয়ার দশা। শুধু একটি আসন কেশপুরের কথা বললেই এই তত্ত্ব স্পষ্ট হয়ে যাবে। কেশপুরই ঘাটাল আসনের ‘প্রাণভোমরা’।

    ২০১৪ সাল থেকে তৃণমূলের কব্জায় ঘাটাল। দু’বার জিতেছেন দেব। প্রথম বার সিপিআইকে হারিয়ে। দ্বিতীয় বার বিজেপিকে। ২০১৪ সালেও চার নম্বরে থাকা বিজেপি এখন ঘাটালে তৃণমূলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। দেবের হ্যাটট্রিক রোখার দায়িত্বে বিজেপির হিরণ। যিনি রাজনীতিতে নেমেই বিধায়ক হয়েছেন। এক বার খড়্গপুর সদর বিধানসভা আসনে জিতেছিলেন দিলীপ ঘোষ। তিনি সাংসদ হলে উপনির্বাচনে আসনটি তৃণমূল জিতে নিয়েছিল। কিন্তু ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে খড়্গপুর সদর আসন বিজেপিতে ফিরিয়ে এনেছেন হিরণ। তিনি এখন খড়্গপুর পুরসভার কাউন্সিলরও বটে।

    পশ্চিম মেদিনীপুরের ছ’টি এবং পূর্ব মেদিনীপুরের একটি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে ঘাটাল লোকসভা। গত লোকসভা নির্বাচনে দু’টি আসনে এগিয়েছিল বিজেপি। কিন্তু নীলবাড়ির লড়াইয়ে পাঁশকুড়া পশ্চিম, সবং, পিংলা, ডেবরা, দাসপুর এবং কেশপুর দখল করে তৃণমূল। একমাত্র ঘাটাল বিধানসভার বিধায়ক বিজেপির।

    ২০১৪ সালে সিপিআই ঘাটালে প্রার্থী করেছিল মেদিনীপুরের প্রাক্তন বিধায়ক সন্তোষ রানাকে। তাঁকে ২ লক্ষের বেশি ভোটে হারান দেব। সে বার কংগ্রেস প্রার্থী করেছিল এখন তৃণমূলের মন্ত্রী মানস ভুঁইয়াকে। মানস ছিলেন তৃতীয়। তাঁর চেয়েও কম ভোট পেয়েছিলেন বিজেপির মহম্মদ আলম। বিজেপির ঝুলিতে ছিল মাত্র ৭ শতাংশের মতো ভোট। কিন্তু পাঁচ বছর পরে সেই বিজেপির ভোট হয়ে যায় প্রায় ৪১ শতাংশ। প্রাক্তন আইপিএস ভারতী ঘোষ পরাজিত হলেও দেবের আড়াই লাখের ব্যবধান কমে এক লাখ হয়ে যায়। তৃতীয় সিপিআই আর চতুর্থ কংগ্রেস মিলে ভোট ছিল ৯ শতাংশের মতো।

    এই ‘বদল’-এ বড় ভূমিকা নিয়েছে কেশপুর। সিঙ্গুর বা নন্দীগ্রাম রাজ্য রাজনীতির চরিত্র হয়ে ওঠার অনেক আগে কেশপুর সেই খ্যাতি কুড়িয়েছিল। চলতি শতাব্দীর একেবারে গোড়ায় কেশপুরকে কেন্দ্র করেই সিপিএম বনাম তৃণমূল লড়াই শুরু হয়। যে লড়াই একটা সময়ে গুলি-বন্দুকের যুদ্ধে পরিণত হয়। রক্ত ঝরে। তখন রাজ্য রাজনীতিতে চমকাইতলা, ছোট আঙারিয়ার মতো এলাকার নাম এলেও সবচেয়ে পরিচিত ছিল কেশপুর। এক দিকে সিপিএমের এন্তাজ আলি আর অন্য দিকে তৃণমূলের মহম্মদ রফিক। সেই সময়েই বিরোধী নেত্রী মমতা স্লোগান তুলেছিলেন, ‘কেশপুর সিপিএমের শেষপুর’!

    সে স্লোগান রাতারাতি সফল হয়নি। অনেক সময় আর অনেক লড়াই দিতে হয়েছে তৃণমূলকে। ২০১১ সালেও সিপিএমের রামেশ্বর দলুই ৩৩,৮৫১ ভোটে জিতেছিলেন। তবে সিপিএম নেত্রী নন্দরানি ডলের রেকর্ড ভোটে জেতা কেশপুরে ঘাসফুল ফুটে যায় ২০১৬ সালে। নন্দীগ্রামের মেয়ে শিউলি সাহা কেশপুরে এসে লক্ষাধিক ভোট জেতেন। আর তার পরে পরেই সেই কেশপুর দেবের ঘাটাল-জয় সহজ করে দেয়। দাসপুর বিধানসভা হাজার দশেক ভোটে এগিয়ে দিলেও বাকিগুলিতে ব্যবধান ছিল খুবই কম। কিন্তু শুধু কেশপুরই দেবকে ৯২ হাজার ভোটে এগিয়ে দিয়েছিল। আর দেবের প্রথম ঘাটাল-জয়ে ২০১৪ সালে কেশপুর তাঁকে এগিয়ে দিয়েছিল ১ লাখ ১৮ হাজারের মতো ভোটে।

    কিন্তু সেই কেশপুর আর নেই। গত বিধানসভা নির্বাচনে শিউলি আবার জিতেছেন। কিন্তু ব্যবধান কমে হয়েছে ২৭ হাজার। পক্ষান্তরে, বিজেপির ভোট বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। এই পরিস্থিতিতে অতীতের দু’বারের মতো কেশপুরে বড় লাফ দিতে পারবেন কি দেব? কারণ, কেশপুরকে কেন্দ্র করেই বিজেপি ঘাটাল জয়ের ‘মাস্টারপ্ল্যান’ বানিয়েছে। যে কোনও উপায়ে কেশপুরে তৃণমূলের এগিয়ে থাকার ব্যবধান কম রাখলেই ঘাটালে বাজিমাত করা যাবে। এই হল বিজেপির অঙ্ক।

    দুই অভিনেতার লড়াইয়ের মধ্যে সিপিআই প্রার্থী করেছে প্রবীণ তপন গঙ্গোপাধ্যায়কে। সিপিআইয়ের কিসান খেতমজুরের রাজ্য সংগঠন সম্পাদক তপন প্রচার করছেন। কিন্তু তাঁর দলের ভোট প্রসার হবে কি? হলেও আর কতটা? ৮ শতাংশ ভোটের পুঁজি নিয়ে কতই বা আশা করা যায়!
  • Link to this news (আনন্দবাজার)