• বহু তারকা সাংসদ দেখা কৃষ্ণনগর এখন নিজেই তারকা, তবে সব রঙ ফিকে হয়ে লড়াই শুধু দুই ফুলের
    আনন্দবাজার | ৩১ মে ২০২৪
  • কৃষ্ণনগর মানে সরপুরিয়া-সরভাজা। কৃষ্ণনগর মানে মাটির পুতুল, জগদ্ধাত্রী পুজো। আবার কৃষ্ণনগর মানে গোপাল ভাঁড়ও। অনেক কিছুর জন্য বিখ্যাত কৃষ্ণনগর লোকসভা আসন থেকে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের অনেক বিখ্যাত মানুষ সাংসদ হয়েছেন। ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী হয়ে জিতেছিলেন হরিপদ চট্টোপাধ্যায়। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী বাঘা যতীনের (যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়) তুতো ভাই ছিলেন।

    এর পরে ১৯৭১ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত কৃষ্ণনগরে টানা আট বার জিতেছে সিপিএম। প্রথম চার বার রেণুপদ দাস এবং পরের চার বার অজয় মুখোপাধ্যায়। দু’জনেই রাজনীতিবিদ হিসাবে খ্যাত ছিলেন। কিন্তু এর পরে ১৯৯৯ সালে বিজেপির টিকিটে জয়ী হন বিখ্যাত আইনজীবী সত্যব্রত (জলু) মুখোপাধ্যায়। তবে সে বার বিজেপি একক শক্তিতে জেতেনি। তৃণমূলের সঙ্গে জোট ছিল পদ্মের। এর পরে এই আসনে সিপিএম প্রার্থী করে ক্রীড়াবিদ জ্যোতির্ময়ী শিকদারকে। ২০০৪ সালে নতুন ট্র্যাকে নেমেই সাফল্য পান জ্যোতির্ময়ী। তবে এক বারই। ২০০৯ সালে হেরে গিয়েছিলেন ৮০০ এবং ১৫০০ মিটার দৌড়ে এশিয়ান গেমসে স্বর্ণপদক জয়ী জ্যোতির্ময়ী। ঘটনাচক্রে, হেরেছিলেন এক তারকার কাছেই। তবে ভিন্ন পেশার তারকা। ২০০৯ সালে কৃষ্ণনগর থেকে সাংসদ হন বাংলা ছবির নায়ক তাপস পাল। মাঝে একবার কুণাল ঘোষ ও অধুনাপ্রয়াত সোমেন মিত্রের কর্মসূচিতে গিয়ে দলবিরোধী কথা বলে নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়। কিন্তু শেষমেশ ২০১৪ সালে মমতা আবার টিকিট দেন তাপসকে। জিতেছিলেন অভিনেতা-রাজনীতিক।

    এর পরে জলঙ্গি নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। কৃষ্ণনগরের প্রাক্তন সাংসদ জ্যোতির্ময়ী প্রথমে তৃণমূল ও পরে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। নায়ক তাপস একটা সময়ে চিটফান্ড কেলেঙ্কারিতে যুক্ত থাকার অভিযোগে ‘খলনায়ক’ হয়ে গিয়েছেন। সাংসদ হওয়ার আগে ২০০১ এবং ২০০৬ সালে আলিপুর বিধানসভা থেকে বিধায়কও থেকেছেন সিনেমার ‘সাহেব’। তবে সাংসদ থাকা অবস্থাতেই সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হয়ে ১৩ মাস কারাবাস করতে হয় তাঁকে। বিতর্কেও জড়িয়ে পড়েছিলেন মহিলাদের নিয়ে ‘কুরুচিকর’ হুমকি দিয়ে। তাপসকে ২০১৯ সালে আর প্রার্থী করেনি তৃণমূল। জামিন পাওয়ার পরে ২০২০ সালে খানিকটা নীরবেই প্রয়াত হন তাপস।

    তত দিনে অবশ্য নতুন ‘তারকা’ পেয়ে গিয়েছে কৃষ্ণনগর। ২০১৬ সালে করিমপুর বিধানসভা আসন থেকে বিধায়ক হয়েছিলেন একদা রাহুল গান্ধীর ‘আম আদমি কা সিপাহি’ মহুয়া মৈত্র। ২০১৯ সালে তিনিই হন কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ। রাজনীতিক হলেও মহুয়া ‘তারকা’। কারণ, তিনি স্বক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠা ছেড়ে রাজনীতিতে এসেছিলেন। মার্কিন মুলুকে উচ্চশিক্ষার পরে আমেরিকাতেই চাকরি করতেন মহুয়া। নিউ ইয়র্কের পরে লন্ডনেও ছিলেন চাকরিসূত্রে। ২০০৮ সালে রাজনীতি করবেন বলেই সব ছেড়ে দেশে ফেরেনএবং কংগ্রেসে যোগ দেন। ২০১০ সালে রাজ্যজুড়ে পুরভোটের আবহে তৃণমূলে যোগ দেন মহুয়া। প্রথমে বিধায়ক এবং পরে সাংসদ হন জোড়াফুলের প্রতীকে।

    সংসদেও ‘তারকা’ হয়ে ওঠেন মহুয়া। দ্বিতীয় নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিভিন্ন নীতি নিয়ে লোকসভায় অন্যতম প্রধান বিরোধী স্বর হয়ে ওঠেন তিনি। সাম্প্রতিক টাকার বিনিময়ে লোকসভায় প্রশ্নের অভিযোগে বিতর্কও তাঁকে তারকার মতোই প্রচারে রেখেছে। সেই অভিযোগে সংসদ থেকে মহুয়াকে বহিষ্কারের পরে দল তাঁকে আবার প্রার্থী করবে কি না তা নিয়ে একটা মহলে জল্পনা তৈরি হয়েছল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মহুয়াতেই ভরসা রেখেছেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মহুয়াও ব্যবধান বাড়িয়ে জয়ের শপথ শুনিয়ে দিয়েছেন।

    কৃষ্ণনগরে সাফল্য বজায় রাখতে পারলেও গত তিনটি নির্বাচনে একটু একটু করে জয়ের ব্যবধান কমেছে তৃণমূলের। তাপস প্রথম বারের তুলনায় দ্বিতীয় বার কম ভোটে জিতেছিলেন। মহুয়ার জয় আসে আরও কম ভোটে। অন্য দিকে, প্রাক্তন সাংসদ সত্যব্রত ২০০৯ এবং ২০১৪ সালে বিজেপির টিকিটে প্রার্থী হয়ে ভোট বাড়িয়ে গিয়েছেন। তবে তৃতীয় স্থানেই থাকতে হয়েছিল তাঁকে। ২০১৯ সালে প্রাক্তন ফুটবলার কল্যাণ চৌবে অবশ্য বিজেপির টিকিটে দ্বিতীয় স্থানে চলে যান। ৪০.৩৭ শতাংশ ভোট পায় বিজেপি। তৃণমূল পায় ৪৫ শতাংশ। সিপিএম এবং কংগ্রেসের যৌথ ভোট দাঁড়ায় ১১ শতাংশের মতো।

    কল্যাণকে এ বার টিকিট দেয়নি বিজেপি। ভারতীয় ফুটবল দলের প্রাক্তন গোলরক্ষক গত বিধানসভা নির্বাচনে মানিকতলা আসনে পরাজিত হয়ে আপাতত সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি। তাঁর বদলে কাকে বিজেপি কৃষ্ণনগরে প্রার্থী করবে, তা নিয়ে জল্পনা ছিল। একটা সময়ে শোনা গিয়েছিল জলুবাবুর পুত্র তথা রাজ্যের প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল সৌমেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের নাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিজেপি কৃষ্ণনগরে ‘রানিমা’ অমৃতা রায়ের নাম ঘোষণা করে।

    সংসদ থেকে বহিষ্কৃত মহুয়া যাতে ফের সংসদে পৌঁছতে না পারেন, তার জন্য বিজেপি চেষ্টার অন্ত রাখছে না। দলের কোনও নেতার উপর ভরসা না রেখে ঐতিহাসিক কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির বধূকে প্রার্থী করার বিষয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীই উদ্যোগী হয়েছিলেন বলেও অনেকে বলেন। বিজেপির পক্ষে স্বয়ং শুভেন্দু অধিকারী দাবি করেন, মোদীর ইচ্ছাতেই বিজেপি প্রার্থী হয়েছেন অমৃতা। প্রার্থী ঘোষণার পরে মোদী ফোনও করেছিলেন অমৃতাকে। সেই কথোপকথন বিজেপির উদ্যোগেই প্রকাশ্যে আসে। পাঁচ মিনিটের কথালাপে কৃষ্ণনগরের রানিমাকে বেশ কিছু ‘রাজনৈতিক পরামর্শ’ দেন প্রধানমন্ত্রী। সেই সময়ে অমৃতার কাছাকাছি থাকা এক বিজেপি নেতার কথায়, ‘‘প্রধানমন্ত্রী মোদী অমৃতাকে ফোন করে বলেন, মনে রাখবেন, কেন্দ্রটা কৃষ্ণনগর। এটা মহুয়ার লোকসভা। এখানে কিন্তু অন্য লড়াই লড়তে হবে।’’

    ভোট ঘোষণার আগেই এক বার কৃষ্ণনগরে এসেছেন মোদী। ভোট ঘোষণার পরেও সভা করেছেন। রাজ্য নেতারাও ঝাঁপিয়ে পড়েছেন মহুয়াকে হারানোর লক্ষ্য নিয়ে। অন্য দিকে, তৃণমূলনেত্রী মমতা মহুয়াকে বড় সার্টিফিকেট দিয়ে রেখেছেন। কৃষ্ণনগরে প্রচারে গিয়ে বলেছেন, ‘‘মহুয়াকে নিয়ে ওদের খুব জ্বালা! ও যে বাঘের বাচ্চা।’’

    ভোটের অঙ্ক আর বর্তমান পরিস্থিতি মিলিয়ে এ বার এই আসনে দুই ফুলের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। কারণ, জেতা আসন হলেও তৃণমূলের চিন্তা রয়েছে কয়েকটি কারণে। গত লোকসভা নির্বাচনে মহুয়ার জয়ের নেপথ্যে ছিল চাপড়া, পলাশিপাড়া, নাকাশিপাড়া ও কালীগঞ্জ বিধানসভা। অন্য দিকে, বিজেপি এগিয়ে ছিল কৃষ্ণনগর উত্তর, কৃষ্ণনগর দক্ষিণ এবং তেহট্টে। এর মধ্যে চাপড়া তৃণমূলের কাছে ‘সম্পদ’ এবং বিজেপির কাছে ‘কাঁটা’। এই একটি আসনেই গত বার প্রায় ৫০ হাজার ভোটে এগিয়েছিলেন মহুয়া। ঠিক তেমনই আবার কৃষ্ণনগর উত্তরে বিজেপি এগিয়ে ছিল ৫০ হাজারের বেশি ভোটে। ওই আসনে গত বিধানসভা নির্বাচনেও বিজেপি জেতে ৩০ হাজারের সামান্য বেশি ভোটে। যদিও বিধায়ক মুকুল রায় পরে তৃণমূলে যোগ দেন। ওই আসনে সংখ্যালঘু ভোট মহুয়ার বড় ভরসা। তবে সেই ভোটে ভাগ বসাতে সিপিএম প্রার্থী করেছে প্রাক্তন বিধায়ক এস এম সাদিকে। সঙ্গে নওশাদ সিদ্দিকির দল আইএসএফের মহিলা প্রার্থী আফরোজা খাতুন। তিনি প্রচারে ভাল সাড়া পাচ্ছেন বলে দাবি। তৃণমূলের কাছে আরও একটি চিন্তা পলাশিপাড়া বিধানসভা। সেখানকার তৃণমূল বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্য নিয়োগ দুর্নীতির দায়ে আপাতত জেলবন্দি। তার ছায়া কি ভোটে পড়বে? নানা দাবি কৃষ্ণনগরে।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)